• ‘সিভিক হতে চাই না, চাকরি ফেরান’, দাবি চাকরিহারাদের
    এই সময় | ০৮ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: মুখ্যমন্ত্রীর মিটিংয়ে কি সমস্যার মীমাংসা হলো? সোমবার ওঁদের জবাবে তেমন একটা প্রত্যয়ী সুর শোনা গেল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরিহারা বেশিরভাগ ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষিকাই জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী ‘চাকরি যাবে না’ বললেও ধন্দ থেকেই গিয়েছে। তবে আগের দিনের হুঁশিয়ারি মতো আন্দোলনের পথে হাঁটেননি তাঁরা। এঁদের অনেকেই রবিবার রাতটা কাটিয়েছেন রাজপথে। সে দিনই তাঁরা বলেছিলেন যে, কোনও আশ্বাস বা ভাতা বা ‘স্টপ গ্যাপ’ ব্যবস্থায় ভুলবেন না। ‘কংক্রিট’ সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। যদিও সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাসের সামনে তেমন সরব হতে দেখা যায়নি এঁদের। কর্মহারাদের গ্যালারি থেকে কিছু আপত্তিসূচক ধ্বনি শোনা গিয়েছে, এ–ই যা।

    এ দিনের বৈঠকে মমতা বারবারই জানান যে, চাকরিহারা ‘যোগ্য’ প্রার্থীদের পাশে রয়েছে রাজ্য সরকার। কোর্টের নির্দেশের পরেও কেউ যে তাঁদের ‘টার্মিনেট’ করেনি, বারবার সে প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। এ কথা জানিয়েই কর্মহারাদের ‘ভলান্টারিলি’ কাজের আহ্বান জানান। তাঁদের স্কুলে যেতে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থরক্ষার কথাও বলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘ভলান্টারি’ শব্দ নিয়ে সভার মধ্যে থেকে প্রশ্ন উঠলেও মমতা বোঝাতে চান, আদালতের রায়ের কথা মাথায় রেখেই তিনি এমন আহ্বান জানাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, দু’মাস কষ্ট করলে ২০ বছরের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে।

    তবে তিনি যা–ই বলুন। মিটিং শেষে এই ‘ভলান্টারি’ কাজের আবেদন নিয়েই সবচেয়ে বেশি সংশয় ও ধন্দ শোনা গেল চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকাদের কথায়। তাঁরা স্কুলে যাবেন কি না, তা নিয়েও থাকল প্রশ্ন। ‘ভলান্টারিলি’ কাজে যোগ দিলে বেতন মিলবে কি না, সেটা স্পষ্ট না হওয়ার কারণেই মূলত দোলাচলে এঁরা।

    কিন্তু সে কথা তেমন ভাবে মিটিংয়ে জানানো হয়নি। গ্যালারি থেকে কিছু প্রশ্ন উড়ে এলেও মুখ্যমন্ত্রীর ‘আশ্বাসের’ পরে সে ভাবে মুখ খোলেননি কেউ। তা হলে রবিবারের কড়া অবস্থান কি সোমবার বদলে গেল? আন্দোলনকারীদের তরফে চিন্ময় মণ্ডলকে এ কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি আর এক নেতা মেহবুব মণ্ডলকে ফোন ধরিয়ে দেন। মেহবুব বলেন, ‘বৈঠকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আমরা আমাদের সব প্রশ্নই তুলেছি। পাশাপাশি আন্দোলন থেকেও নিজেদের প্রত্যাহার করিনি। যদি তা করতাম, তা হলে বলা যেত যে আমরা সুর নরম করেছি। আগে যে সব প্রশ্ন ও দাবি আমাদের ছিল, মিটিংয়ের পরেও তা–ই আছে।’

    কিন্তু মেহবুবদের মতো এত সাজানো গোছানো জবাব এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত সাধারণ কর্মহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারা দিতে পারেননি। যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ব্রজবল্লভপুরের একটি স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা অন্নপূর্ণা হেমব্রম। সেখানে ওই বিষয়ে তিনিই একমাত্র টিচার। তাঁর কথায়, ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অনেক আশ্বাস দিলেন। কিন্তু আমরা তো ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান! মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে চাকরি যাবে না, আমরা যেন কাজে যাই। ওঁর কথা মেনে কাজে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টা কোথায় দাঁড়াল, সেটা জানতে অপেক্ষাতেই থাকলাম।’ পূর্ব মেদিনীপুরের সাঁতরা কমললোচন হাইস্কুলের ফিজ়িক্সের টিচার অভিজিৎ করণ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বললেন, চাকরি ফেরাবেন। কিন্তু তার দিশা বললেন না। ভলান্টারি নিয়োগ মানে ঠিক কী? আমাদের তো নিয়োগ করেছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। কাজেই এই নিয়োগের দায় সরকার এড়াতে পারে না। তারাই যোগ্য–অযোগ্য বাছাই করুক। কোর্ট এখানে কী করবে?’

    হুগলির গুপ্তিপাড়ার একটি স্কুলে কেমিস্ট্রি পড়ান তৃষা দাস। কর্মস্থলের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। ইন্ডোরের বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘স্যালারি পাব কি না, সেটা মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করলেন না। স্কুলে যেতে হলে আমাকে বাড়ির ভাড়া গুনতে হবে। বেতন না পেলে সেটা করব কি না, স্কুলে যাব কি না, এ সব ভেবে দেখতে হবে।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের একটি স্কুলের তিন শিক্ষক ইল্লাজুর রহমান, মহাদেব বর ও দেবব্রত নস্কররা জানান, তাঁদের ঘাড়ে ঋণের বোঝা, নানা দায়দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।

    মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঠিক কী বলেছেন? ‘যোগ্যদের’ উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘কেউ তো আপনাদের টার্মিনেট করেনি। আপনাদের কেউ স্কুলে যেতে বারণ করেছে? স্কুলে যান না, কে বারণ করেছে? ভলান্টারিলি সবাই সার্ভিস দিতে পারে।’ তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভগবানগোলার শিক্ষিকা সুমনা দাস বলেন, ‘বহুবার ভেরিফিকেশনের পরে আমরা চাকরি পেয়েছি। আমাদের সামাজিক সম্মান ফেরাতে হবে। কোনও ভলান্টারি সার্ভিস আমরা করব না।’ শান্তিপুরের মৌমিতা দত্তর স্কুল বহরমপুরে। বাড়িতে দেড় বছরের শিশুসন্তান। তিনিও বলেন, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না আসলে কী হলো! মূলত স্যালারি নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে আছি।’ শিক্ষিকা অন্তরা মাঝিরও প্রশ্ন বেতন নিয়ে।

    হুগলির শিক্ষিকা পল্লবী লাহা আবার অন্য প্রশ্ন তুলছেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের বলা হচ্ছে স্কুলে পড়াতে যেতে। আমার বাড়ি বর্ধমানে। পরে যদি বলা হয় যে আমাদের ফের পরীক্ষায় বসতে হবে, তা হলে এতদূর যাতায়াত করে প্রস্তুতি নেব কখন?’

    এর সঙ্গেই আছে সামাজিক সম্মানের প্রশ্ন। পুরুলিয়ার বাসিন্দা কাকলি দরিপা পড়ান মালদার একটি স্কুলে। স্বামী সামান্য কাজ করেন। তাঁর আয়েই মূলত সংসার চলে। এখন তাঁর সংসার ও সম্মান, দু’ক্ষেত্রেই প্রশ্ন। সমাধানের আশায় ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে তিনি। কলকাতার দেবলীনা বিশ্বাসের স্কুল মুর্শিদাবাদে। বৈঠক শেষে বেরিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনলাম। ভলান্টারি সার্ভিস প্রসঙ্গে খটকা আছে। যতক্ষণ না ওঁর আশ্বাসগুলি কার্যকর হচ্ছে, ততক্ষণ দ্বিধা কাটবে না।’

  • Link to this news (এই সময়)