• অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়া সিজ়ার কোমায়, সুস্থ সন্তান এবং মা
    এই সময় | ০৮ এপ্রিল ২০২৫
  • রাতদুপুরে ৩৬ সপ্তাহের প্রসূতি যখন হাসপাতালে আসেন, ততক্ষণে তাঁর ছ’বার খিঁচুনি আর দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গিয়েছে। তাপসী ঘোষ নামে কোমায় চলে যাওয়া টাকির ওই বছর ঊনিশের তরুণীকে নিয়ে এতটুকু সময় নষ্ট করেননি জুনিয়র ডাক্তাররা। দ্রুত সিপিআর দিয়ে ফিরিয়ে আনেন হৃদস্পন্দন। মৃত্যুর মুখে কোমায় থাকা সেই প্রসূতির এবং তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের প্রাণরক্ষার তখন একটাই উপায় ছিল— সিজ়ার করা।

    ডাক্তারি পরিভাষায় যে বিরল অপারেশনকে বলে পেরিমর্টেম সিজ়ার। সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি সিনিয়র ডাক্তাররা। সঙ্কটজনক ওই বিরল পরিস্থিতিতে অসাধ্য সাধন করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকেরা। মৃত্যুর দোরগোড়ায়, ভেন্টিলেশনে রেখে অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই সিজ়ার করে সুস্থ নবজাতকের জন্ম দেওয়া হয়। পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন মা–ও। সোমবার ফুটফুটে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন তাপসী।

    মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ তথা সুপার অঞ্জন অধিকারী বলেন, ‘প্রসূতির চিকিৎসায় আমাদের ইডেন হাসপাতালের যে ঐতিহ্য, পেরিমর্টেম সিজ়ারিয়ান সেকশনে তার উৎকর্ষতা আবার প্রমাণিত হলো।’ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের যে ইউনিটের অধীনে তাপসীর সিজ়ার ও চিকিৎসা হয়েছে, সেই ইউনিটের প্রধান চিকিৎসক সম্রাট চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, তাঁর বিভাগের চিকিৎসকদের পাশাপাশি অ্যানাস্থেশিওলজি ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের জুনিয়র ও সিনিয়র ডাক্তার মিলিয়ে ২০ জনের চিকিৎসকদল অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে নিপুণ কাজ করার পাশাপাশি প্রাণপাত করেছিলেন বলেই ওই তরুণীর প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।

    হাসপাতাল সূত্রে খবর, মুমূর্ষু অবস্থায় গত ১১ মার্চ রাত ১২টার একটু আগে মেডিক্যালে এসেছিলেন তাপসী। তাঁকে উত্তর ২৪ পরগনার জিরানগাছা ব্লক হাসপাতাল থেকে আরজি করে রেফার করা হয়েছিল। কিন্তু পরিজন সেখানে না গিয়ে মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। ততক্ষণে পাঁচ বার খিঁচুনি হয়ে গিয়েছে তাপসীর। ইডেন হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছেই ফের এক বার খিঁচুনি হয়। পাকস্থলীর খাদ্যাবশেষ উঠে এসে ঢুকে যায় শ্বাসনালীতে। পর পর দু’টি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতেই স্তব্ধ হয়ে যায় হৃদযন্ত্র। সময় নষ্ট না করে কার্ডিয়ো-পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) দিতে শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা।

    সম্রাটের কথায়, ‘প্রসূতির সিপিআর দেওয়া সহজ নয়। চিৎ করে নয়, এক দিকে কাত করিয়ে একটু বিশেষ ভাবে সিপিআর দিতে হয়। আমাদের চিকিৎসকেরা সঙ্কটের মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে একেবারে ঠিক কাজটা না করলে পেরিমর্টেম সিজ়ারের সুযোগটুকুও মিলত না।’ তিনি জানাচ্ছেন, হৃদস্পন্দন ফিরে আসতেই অ্যানাস্থেটিস্টরা শ্বাসনালীতে টিউব পরিয়ে ভেন্টিলেশনে দিয়ে দেন তাপসীকে। অস্ত্রোপচার দলের অন্যতম সদস্য, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নীতা রায় বলেন, ‘সে সময়ে প্রথম লক্ষ্য ছিল, গর্ভস্থ শিশুর প্রাণ বাঁচানো। তাই ইমার্জেন্সিতেই ভেন্টিলেশনে রেখে পেরিমর্টেম সিজ়ার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুস্থ নবজাতক জন্মায়। সদ্যোজাতের ওজন ২.৭ কেজি।’

    মেডিক্যালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক তপন নস্কর জানান, যে অবস্থায় ছিলেন ওই প্রসূতি, তাতে প্রথাগত অ্যানাস্থেশিয়ার দরকারই পড়েনি। নীতা জানান, সিজ়ারের পর ধীরে ধীরে তাপসীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখা যায়। তাও ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়। কয়েক দিন পর ভেন্টিলেশন থেকে বের করা হয় তাপসীকে। গত ২১ মার্চ তাঁকে সিসিইউ থেকে এক ধাপ নামিয়ে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রাখা হয়।

    অবশেষে সোমবার ছুটি পেলেন তাপসী। কোলে ছেলে নিয়ে ছুটির আগে গোটা মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে ছবিও তোলেন তিনি। সেই টিমে সামিল ছিলেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট সাবিহা নাজ় ও সোহিনী ঘোষ দস্তিদার এবং স্নাতকোত্তর পড়ুয়ারা। অ্যানাস্থেশিয়া টিমে ছিলেন মৌমী ঘোষ, চয়ন দাস ও দীপাঞ্জন বিশ্বাস এবং সিসিইউ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক দেবাশিস ঘোষ।

  • Link to this news (এই সময়)