এই সময়, কৃষ্ণনগর: নদিয়ার নবদ্বীপে শিব গণমানুষের দেবতা। সোমবার বাসন্তী–দশমীর শেষ রাতে (মঙ্গলবার ভোর চারটে নাগাদ) শিব-পার্বতীর বিয়ে। ঐতিহ্যের উৎসব, লৌকিক আচার মেনেই বিয়ের আয়োজন হয়েছে। তবে এখানেও এ বার জুড়ল এসএসসি–র চাকরি–বাতিল প্রসঙ্গ। জামাই অর্থাৎ শিবের চাকরি চলে যাবে না তো? এমন টিপ্পনীও ছুঁড়ে দিচ্ছেন ‘কনেপক্ষ’ অর্থাৎ পার্বতীর দিকের রসিক লোকজন। তাঁদের যুক্তি—মেয়ের বিয়েতে টিভি, ফ্রিজ়, ওয়াশিং মেসিন, বক্স–খাট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড ফোন সবই যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছে, তাই তাঁরা ‘জামাই’কে একটু বাজিয়ে নিতে চান।
নবদ্বীপের বুড়োশিব, যোগনাথ শিব, বালকনাথ শিব-সহ পাঁচটি প্রাচীন শিব মন্দিরের সামনে ঢাকঢোল, ব্যান্ড পার্টির বাজনা শুরু হয়েছে সোমবার সন্ধে থেকেই। পুরোহিত, প্রামাণিক এবং বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে মালাবদল, সাত পাক-সহ যাবতীয় অনুষ্ঠানই হবে। ভোররাতে ‘বাবার বিয়ে’ দেখতে আসা সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবেন উৎসবের আয়োজকরা। এই অন্য রকম উৎসব ঘিরে সোমবার রাত থেকেই ভিড় জমেছে ওই সব শিবমন্দিরের সামনে। সব থেকে বেশি ভিড় প্রাচীন বুড়ো শিবমন্দিরের সামনে। প্রথা মেনে মন্দিরের সামনে প্যান্ডেল বেঁধে বিয়ের দান-সামগ্রীও রাখা হয়েছে। সেখানে কী নেই! কনের বেনারসি-সহ গুচ্ছ শাড়ি, বরের ধুতি–পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে দু’জনের প্রসাধনী, চটি—সবই।
বুড়ো শিবমন্দিরের অন্যতম ট্রাস্টি অরূপ সাহা বলেন, ‘এক সময়ে ঘড়ি, সাইকেল, পিতল–কাঁসার বাসন, সোনার আংটি, বোতাম, খাট-পালঙ্ক উপহার হিসেবে সাজিয়ে রাখা হতো ছাদনাতলায়। কিন্তু দিন বদলেছে। তাই এখন ফ্রিজ়, টিভি, বক্স–খাট, আলমারি, মোটরবাইক, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, দামি মোবাইল রাখা হয়। তবে এগুলি রেখে যান শহরের ব্যবসায়ীরা। যিনি যা দিয়েছেন, অনুষ্ঠান শেষে তিনি ফেরতও নিয়ে যান।’
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, ‘পণ্ডিত সমাজের জায়গা নবদ্বীপের পণ্ডিতদের মাথায় এক সময়ে এমন উৎসবের ভাবনা এসেছিল। অবশ্য পুরাণেও শিবের বিয়ের উল্লেখ রয়েছে। নবদ্বীপে কবে থেকে এই উৎসব চালু হয়েছে, জানা যায় না। তবে মোটামুটি ১৭০০ সালের শেষ দিকে শুরু হয়েছিল বলে অনুসন্ধানে জেনেছি।’ প্রথা অনুযায়ী প্রথমে বুড়োরাজ শিবমন্দিরে এই উৎসব শুরু হয়। তার পর একে একে শহরের যোগনাথ শিব, বালকনাথ শিব, বানেশ্বর শিব, দণ্ডপাণিতলার শিবের বিয়ে শুরু হয়। পাঁচ-ছ’টি মন্দিরে একই দিনে অর্থাৎ চৈত্র মাসে বাসন্তী–দশমীর শেষে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। বাংলায় এমন উৎসব আর কোথাও হয় না বলেই জানাচ্ছেন শান্তিরঞ্জন।
এই শিবমন্দিরগুলিতে বাসন্তীপুজোর আয়োজন হয়েছিল তিথি মেনেই। মঙ্গলবার ভোররাতে চতুর্দোলায় চাপিয়ে কাঁধে করে আনা হবে পার্বতী অর্থাৎ মৃণ্ময়ী বাসন্তীদেবীকে। আর মন্দির থেকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে বাইরে বের করে আনা হবে শিবকে। বুড়ো শিবতলা উৎসব কমিটির অরূপ সাহা বলেন, ‘বিয়ের উৎসব শেষে মঙ্গলবার ভোররাতে সবাইকে লুচি মিষ্টি খাওয়াব আমরা।’ দণ্ডপাণিতলা শিবের বিয়ের অনুষ্ঠানে যুক্ত নবেন্দু সাহা বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় মধ্যরাতেই হয় এমন বিয়ের অনুষ্ঠান। সামাজিক নিয়মে শিব–পার্বতীর বিয়ে হয় বলে অনেকে আনন্দানুষ্ঠান ঘিরে তামাশাও করেন। হিন্দুসমাজে কোনও বিয়েতে যেমন হয়, সে রকমই।’ ‘কনে–পক্ষে’র এক মহিলার সরস মন্তব্য, ‘যা দিনকাল, জামাইয়ের চাকরি থাকবে তো! মেয়েটা জলে পড়বে না তো?’