এই সময়: দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ঘুমোতে যান অনেক দেরিতে। আর সেই ‘লেট স্লিপার’দের তালিকায় মুম্বই, বেঙ্গালুরুকে পিছনে ফেলে পয়লা নম্বরে রয়েছে কলকাতা। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠেও ক্লান্তি, গা ম্যাজম্যাজ অনুভূতি পিছু ছাড়ে না অধিকাংশেরই। একটি সর্বভারতীয় সমীক্ষায় উঠে এল এমনই তথ্য। গদি প্রস্তুতকারক একটি নামজাদা বেসরকারি সংস্থার করা ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান স্লিপ স্কোরকার্ড ২০২৫’ সমীক্ষা বলছে, ৫৮% ভারতীয়ই রাত ১১টার আগে ঘুমোতে যান না। আর কলকাতায় এই অনুপাত ৭৩% ছুঁইছুঁই।
ফলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি সিংহভাগ মানুষ যে মেনে চলছেন না, তা স্পষ্ট। ২০২৪-এর মার্চ থেকে ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৪,৫০০ জনের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে এই ফল মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টাডির এই ফলাফল রীতিমতো উদ্বেগের। কারণ, শুধু ক্লান্তি, গা ম্যাজম্যাজ কিংবা ঘুম-ঘুম ভাবই নয়, গুচ্ছ বিপাকজনিত শারীরিক সমস্যার মূলেও রয়েছে এই দেরিতে ঘুমোতে যাওয়ার বদভ্যাস। এতে রোজ রাতে শরীরের প্রাকৃতিক জৈব-ঘড়ির সঙ্গে সংঘাত হয় যা আখেরে ক্ষতি করে শরীরেরই।
সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে দেরিতে ঘুমোতে যাওয়ার কারণও। দেখা গিয়েছে, প্রধানতম কারণ হলো মোবাইল ফোন ঘাঁটাঘাঁটি। কেউ চ্যাটে ব্যস্ত থাকেন তো কেউ নেট সার্ফিংয়ে। কেউ বিঞ্জ ওয়াচিং তো কেউ আবার মজে থাকেন ওটিটি-তে। রয়েছে টিভি, ট্যাব ও ল্যাপটপে সক্রিয় থাকার অভ্যাসও। মোটের উপরে রাতবিরেতে বিনোদনে মজে ওঠার প্রবণতা বৃদ্ধির দিকেই আঙুল তুলেছে এই সমীক্ষা। এবং এই বিষয়টি অভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মন্দের ভালো অবস্থা চেন্নাই ও হায়দরাবাদের। তবে সেখানকার গড়পরতা লোকজনের মধ্যেও প্রায় ৫৫% মানুষ রাত ১১টার আগে ঘুমোতে যান না।
এর ফলও ভুগছে জনতা। সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে, এই লেট স্লিপারদের মধ্যে ৪৪% লোকজনই ঘুম থেকে উঠে চনমনে অনভূতি থেকে বঞ্চিত হন। ৫৯% লোকজনের দিনভরের সঙ্গী হয় ঝিমুনি। সঙ্গে থাকে ক্লান্তি। যা সারা দিনই তাঁদের কাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সমীক্ষায় আরও যে মারাত্মক বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মোবাইল ঘাঁটার অভ্যাস রয়েছে দেশের বিভিন্ন শহর নির্বিশেষে ৮৪-৯০% মানুষের মধ্যে। ফুসফুস তথা ঘুম বিশেষজ্ঞ অরূপ হালদার বলেন, ‘এই সব ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে নীল আলো বেরোয়। এই আলো ঘুম আনতে সহায়ক যে হরমোন, সেই মেলাটোনিনের ক্ষরণ কমিয়ে দেয়। ফলে দেরিতে ঘুম আসে। এবং গভীর ঘুম হয় না।’
চিকিৎসকেরা তাই ঘুমোতে যাওয়ার এক-দু’ ঘণ্টা আগেই স্ক্রিন দেখা বন্ধ করারই পরামর্শ দিচ্ছেন। স্লিপ মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌরভ দাস বলেন, ‘এই স্টাডি একটি ভয়ঙ্কর সত্যি প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। জেনেবুঝে লোকে ঘুমের সঙ্গে আপস করছেন। এতে শুধু ক্লান্তি ও মনোযোগে ব্যাঘ্যাতই দেখা যাচ্ছে না, বিপাকেরও অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, ওবেসিটি, অ্যাংজ়াইটি—সব কিছুরই ঝুঁকি বাড়ে এতে। ভুলে গেলে চলবে না, রাত ১০টায় ঘুমোতে যাওয়া এবং অন্তত সাত ঘণ্টা ঘুমের ব্যাপারটা ঐচ্ছিক বিষয় হতে পারে না।’
তাঁর সঙ্গে একমত কলকাতার একটি স্লিপ ল্যাবের কর্ণধার সোমনাথ মাইতিও। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বিপদ হচ্ছে কমবয়সিদের নিয়ে। ওরা তো ভোর পর্যন্ত মোবাইল ঘাঁটে। এতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারবে না। রাতটা যে ঘুমোনোর জন্য প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা অনেকেই ভুলে যান। ব্রেনের ইইজি করলে আমরা ল্যাবে বুঝতে পারি যে টানা এই বদভ্যাসের জেরে মস্তিষ্কের জৈব-ঘড়ি নিজেই বুঝে উঠতে পারে না, কখন ঘুমোনো উচিত। একটা সময়ে এই বদভ্যাস রোগে পরিণত হয়।’ ইএনটি তথা ঘুম বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্ত অবশ্য এই সমীক্ষার ফলাফলকে ‘বিপজ্জনক প্রবণতা’ আখ্যা দিয়েও মনে করেন, এত বড় দেশে আরও অনেক বেশি লোকের উপরে সমীক্ষা চালানো গেলে প্রকৃত চিত্রটা আরও স্পষ্ট হতো।