• মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও স্কুলেই গেলেন না শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা, বিঘ্ন লেখাপড়ায়
    এই সময় | ০৯ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: ‘যোগ্য’ শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের একজনেরও চাকরি তিনি যেতে দেবেন না বলে সোমবারই নেতাজি ইন্ডোরের বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের উদ্দেশে স্কুলে গিয়ে ‘ভলান্টারি সার্ভিসের’ আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি। আহ্বানে কেমন সাড়া মেলে, মঙ্গলবার ছিল তার উত্তর পাওয়ার দিন। কিন্তু এ দিন রাজ্যের বড় অংশেই তেমন আশাব্যঞ্জক চিত্র ধরা পড়ল না। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের অনেকে কাজে যোগ না দেওয়ায় প্রভাবিত হলো ফাইভ টু টেনের পঠনপাঠন থেকে পরীক্ষা, সবই। অথচ সোমবার মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে ‘যোগ্যদের’ একজনেরও চাকরি যাবে না। শিক্ষা জগতের অনেকেই আশা করেছিলেন, খোদ প্রশাসনিক প্রধানের কাছ থেকে এমন আশ্বাসে এবং ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে স্কুলে যাবেন কর্মহারারা।

    কিন্তু সেই ধারণা মিলল না কেন? চাকরিহারাদের বক্তব্য, গত বৃহস্পতিবার শীর্ষ কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন তাঁদের মতো প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্লেখ করে এসএসসি–কে দ্রুত নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য পদক্ষেপ করতে বলছেন স্কুলশিক্ষা সচিব। তাই তাঁদের বড় অংশ মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রী মুখে যা–ই বলুন না কেন, রাজ্য প্রশাসন অন্য পথে হাঁটছে।

    যদিও এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও মঙ্গলবার বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটাকেই চূড়ান্ত বলে ধরা উচিত শিক্ষকদের। তাঁদের একাংশ যদি কাজে না যান, সেটা তাঁদের অভিরুচি। মুখ্যমন্ত্রী যথেষ্ট মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টা বলেছেন। তিনি যা বলেছেন, তাতে সাড়া দেওয়া উচিত।’

    কর্মহারাদের অধিকাংশ অবশ্য কোনও আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের পাল্টা যুক্তি, ‘প্রতি মাসে যে পোর্টালের মাধ্যমে আমাদের বেতন হয়, সেই স্যালারি পোর্টাল খোলা যাচ্ছে না! এ দিকে ১০ তারিখের মধ্যে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের স্যালারি রিকুইজ়িশন জমা দেওয়ার কথা স্কুলের।’

    সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর ‘ভলান্টারি সার্ভিসের’ আহ্বানের পরে এই বেতনের প্রশ্নেই সবচেয়ে বেশি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা। এখন পোর্টাল খুলতে গেলে ‘রক্ষণাবেক্ষণের’ বার্তা মেলায় তাঁদের সংশয় বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সুপ্রিম কোর্ট কী ক্ল্যারিফিকেশন দেয়, সেটা আগে দেখতে হবে।’

    সোমবারের মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার জানিয়েছেন যে, আদালতের কাছে ক্ল্যারিফিকেশন চাওয়া হবে। এ ব্যাপারে আইনি লড়াইয়ের জন্য দেশের তাবড় তাবড় আইনজীবীদের সহায়তা নেওয়া হবে বলেও মঞ্চ থেকে জানিয়েছিলেন তিনি। এমনকী, এই শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের কেউ ‘টার্মিনেট’ না–করায় তাঁদের যে স্কুলে যেতে বাধা নেই, সে কথা বোঝান তিনি। তার পরদিন রাজ্যের ছবিটা কেমন?

    কলকাতার লেক টাউন গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড গার্লস হাইস্কুলের তিন জন টিচারের চাকরি গিয়েছে। তাঁদের কেউই এ দিন স্কুলে যাননি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঝাঁপবেড়িয়া হাইস্কুলে ন’জন চাকরি খুইয়েছেন। এ দিন স্কুলে যান মাত্র একজন। উত্তর ২৪ পরগনার আটঘড়া হাইস্কুলে চারজনের চাকরি গিয়েছে। এ দিন সকলেই গরহাজির ছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনারই চাতরা নেতাজি বালিকা শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষিকা সোমা ঘোষ মঙ্গলবার বলেন, ‘আমাদের চারজন শিক্ষিকার চাকরি গিয়েছে। একজনও আসেননি।’ মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা থেকে কলকাতা — কার্যত সব জেলাতেই এক চিত্র ধরা পড়ে মঙ্গলবার।

    নদিয়ার ভাতজাংলা কালীপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌভিক কর্মকার এ দিন স্কুলে যাননি। কেন? তাঁর সাফ জবাব, ‘যোগ্যদের জন্য ঠিক কী ব্যবস্থা হয়, সেটা যথাযথ ভাবে বুঝে তারপর স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’ পলাশির মীরা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চাকরিহারা ১১ জন শিক্ষক ও দু’জন শিক্ষাকর্মীর মধ্যে সকলেই এ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে আছেন শিক্ষিকা সায়ন্তনী বসু রায়। তাঁর বক্তব্য, ‘আমি বাড়িতেই আছি। হারানো সম্মান ফিরে পেলে, তবেই স্কুলে যাব। ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধের কথা ভেবে স্কুলে যেতে হতে পারে। তবে সিভিক টিচার হতে চাই না।’ কালীগঞ্জের বল্লভপাড়া জগন্নাথ আশ্রম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কৃষ্ণনগরের কালীনগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় — সর্বত্র এক ছবি।

    পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামেও বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষকরা এ দিন গরহাজির ছিলেন। তবে পথে নেমে আন্দোলনে সামিল হন অনেকে। সোমবারের কথারই প্রতিধ্বনি তাঁদের গলায়। এঁদের বক্তব্য, ‘আর ললিপপে ভুলব না। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হতে চাই না আমরা। যোগ্য মর্যাদা–সহ স্কুলে ফেরাতে হবে আমাদের। না হলে এই আন্দোলন সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে।’

    ‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চে’র রাজ্য কনভেনর সঙ্গীতা সাহা বলেন, ‘কোন অধিকারে স্কুলে যাব? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমাদের চাকরি গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারছি না। আমরা চাই, সরকার যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করুক।’

    শুধু পূর্ব মেদিনীপুরেই হাজার দেড়েক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি খুইয়েছেন। পাঁশকুড়ার শ্যামসুন্দরপুর পাটনা কৃষ্ণচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। এ দিন তাঁদের কেউ স্কুলে যাননি। খেজুরি, মুগবেড়িয়া, কাঁথি, দেশদত্তবাড়, নয়াপুট, এগরা, পাঁশকুড়া, ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল — কোথাও ব্যতিক্রমী চিত্রের দেখা মেলেনি।

    এরই মধ্যে আবার শ্যামসুন্দরপুর পাটনা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ দিন ‘যোগ্যরা’ হাজির হলেও প্রধান শিক্ষক শেখ গোলাম মুস্তাফা হাজিরা খাতায় সই করতে দেননি তাঁদের। তাঁর কথায়, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্যানেল বাতিল করার পরে একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি চাকরিহারাদের কী ভাবে সই করতে দিই! তবে কেউ ক্লাস নিতে চাইলে, বারণ করতে পারব না।’

    তবে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে স্কুলমুখী হয়েছেন বীরভূমের সাঁইথিয়া হাইস্কুলের চার শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে আছেন জীবনবিজ্ঞানের সজল দাস ও রসায়নের সনাতন ঘোষ। তাঁরা বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে এবং ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবেই স্কুলে এসেছি। আসব।’

    বীরভূমেরই নলহাটি বালিকা বিদ্যালয় ও কীর্ণাহারের হাটকালুহা বাদশাহি উচ্চ বিদ্যালয়ে আবার অন্য চিত্র। জেলার মধ্যে এই দুই স্কুলেই চাকরি খুইয়েছেন সবচেয়ে বেশি শিক্ষক–শিক্ষিকা। দু’টিতেই আট জন করে টিচারের চাকরি গিয়েছে। নলহাটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বিদিশা সিংহ এবং হাটকালুহা হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পুলক পাল বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে আশা করেছিলাম যে, এই শিক্ষক–শিক্ষিকারা স্কুলে আসবেন। কিন্তু তাঁরা আসেননি।’

    সোমবারের মিটিংয়ের পরে নেতাজি ইন্ডোরেই এক শিক্ষিকা বলেছিলেন — ‘সিভিক হব না, স্কুলের চাকরি ফেরান।’ মঙ্গলবারের পরে অনেকেই মনে করছেন, ওই বক্তব্য তাঁর একার নয়। আদতে অধিকাংশ চাকরিহারাই এ কথা ভাবছেন।

  • Link to this news (এই সময়)