আমার তখন ছ’মাস বয়স। বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা থেকে চলে যাই জলপাইগুড়ির নয়াবস্তি পাড়ার পোস্টাল কোয়ার্টারে। শিশু নিকেতন, রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় হয়ে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স। ২০০১ সালে বিবাহ সূত্রে পাড়ি দিলাম লন্ডনে। এখানে আমার দুই সন্তানের জন্ম হলো। তার পরে একদিন স্বামীর সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে চলে এলাম বার্টন আপঅন ট্রেন্ট শহরে। আবার শুরু করলাম পড়াশোনা। শিক্ষকতার চাকরিও পেলাম।
সামনে বাংলা নববর্ষ। আমি এখানে স্থানীয় ক্লাবের কালচারাল সেক্রেটারি। নববর্ষে সবাইকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করছি। বাঙালির যা কিছু কালচার, সব শিখেছি মায়ের কাছে। বিদেশে বড় হওয়ায় সন্তানরা যাতে বাঙালি ঐতিহ্যকে জানতে পারে, সেটা সব সময়ে চেষ্টা করি। মেয়েকে বাংলা গান শেখালাম। সারাদিনে অন্তত একবার আমাদের পাতে পড়ে বাঙালি খাবার। পোস্ত থেকে মাছের ঝোল -সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছি ছেলেমেয়েকে। পুঁটি থেকে পাবদা, কই, ইলিশ–সবই পাওয়া যায় এখানে। ছেলে এখন বাড়ি থেকে দূরে ইউনিভার্সিটিতে থাকে। তবু দুর্গাপুজোর যে কোনও এক দিন ক্লাস থেকে ফিরে ওখানকার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে শহরের কোনও বাঙালি কমিটির পুজোয় গিয়ে অঞ্জলি দেয়, প্রসাদ খায়।
পয়লা বৈশাখের কয়েকটা দিন আগে থেকে মনের কোনায় উঁকি দিচ্ছে আমার পুরোনো শহর। মনে পড়ে, নতুন জামা পরে মায়ের সঙ্গে যেতাম তেলিপাড়া কালীবাড়িতে। চড়ক সংক্রান্তির আগের দিন সন্তানের মঙ্গল কামনায় মা নীলষষ্ঠীর পুজো করতেন। সেই পরম্পরা আমিও বহন করি। সে দিন উপবাস। তবে নির্জলা নয়, চা খাই। মন্দিরে আর যাওয়া হয় না। ঘরেই শিবের মাথায় জল ঢেলে দিই। সাবু–কলা মেখে খাই। শুধু নববর্ষ নয়, সরস্বতী পুজোর দিন কাঁচা হলুদ বাটা দিয়ে স্নান, বাসন্তী রঙের পোশাক পরে ঠাকুরের সামনে খাগের কলম দিয়ে লেখা—সব মনে পড়ে। পুজোর পরে ফণীন্দ্রদেব স্কুলের সামনে থেকে ঝালনুন মাখানো বনকুল খাওয়া, তিস্তা উদ্যানে আড্ডা -- আরও কত কী। এখানে বেলপাতা আর পলাশ ফুল পাই না। নারকেল কুল আর আতপ চাল কিনতে হলে বাড়ি থেকে ষাট-সত্তর মাইল গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। স্থানীয় ক্লাবে প্রতি বছর আমরা সবাই মিলে কালীপুজো করি। এক বন্ধুর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোও হয়।
মা মারা গিয়েছেন তিন বছর আগে। বাবাও এখন আর জলপাইগুড়িতে থাকেন না। কয়েক বছর পর পর যাই শিলিগুড়িতে মেজোকাকার বাড়িতে। ফেরার সময়ে বাবা–কাকার কাছ থেকে নিয়ে আসি গোবিন্দভোগ চাল, পাটালি গুড়- সবই। কেন? পায়েস রান্না করতে। মা বলতেন, জন্মদিনে পায়েস খেলে পুণ্য হয়। তাই ছেলেমেয়ের জন্মদিনে কেক কাটার পাশাপাশি পায়েসও রান্না করি।
অনুলিখন: সুদীপ দত্ত