সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে মঙ্গলবার সকাল সকাল স্কুলে ঢুকেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতনের নিমপুর-বরঙ্গী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অরূপ প্রধান। মনটা একটু ফুরফুরে ছিল। ভেবেছিলেন, এ দিন হয়তো আবার ৩ এপ্রিলের আগের মতো গমগম করবে স্টাফরুম। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। ১১টা বেজে গিয়েছে। একবার অফিস থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন। না, কাউকেই দেখা গেল না। এ ভাবেই সাড়ে ১১টা বেজে গেল।
গেটের কাছেই চাকরিহারা শিক্ষকদের অপেক্ষায় প্রধান শিক্ষিক! কিন্তু কোথায় কী? শেষে একরাশ হতাশা নিয়ে স্কুলে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। স্কুলের অন্য শিক্ষকরাও মাথায় হাত দিয়ে স্টাফরুমে বসে আছেন। অরূপ বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম দেরি করে হলেও হয়তো শিক্ষকরা স্কুলে আসবেন। সবাই তো মানসিক চাপে রয়েছেন। কিন্তু ১২টা বাজতেই বুঝলাম, আর কেউ স্কুলে আসবেন না। এ দিকে সদ্য শেষ হয়েছে স্কুলের সেমেস্টার পরীক্ষা। খাতা দেখবেন কে? স্কুলে ছেলেমেয়েগুলোর ক্লাসের কী হবে? সে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে একটু আশার আলো দেখেছিলাম। কিন্তু কোথায় কী।’
এই স্কুল থেকে ৮ জনের চাকরি গিয়েছে। মাত্র ৬ জন শিক্ষককে নিয়ে ৮টি ক্লাস কী ভাবে চলবে? উত্তর জানা নেই প্রধান শিক্ষকের! স্কুলের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন নারায়ণগড়ের শশীন্দা সাগরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর তিওয়ারি। নিরাশ তিনিও। স্কুলের ১৭ জন শিক্ষকের মধ্যে সুপ্রিম–নির্দেশে ৮ জনের চাকরি গিয়েছে। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, নিউট্রিশন, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়াবেন কে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপঙ্করের জবাব, ‘কেউ আসেননি। আমি তো কাউকে আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করতে পারি না। আরও দু–একদিন দেখি।’ কেশিয়াড়ির নছিপুর আদিবাসী হাইস্কুলেরও একই অবস্থা।
যে স্কুল থেকে ১০ জনের চাকরি গিয়েছে। প্রধান শিক্ষক স্বপন পড়্যার আফসোস, ‘আশা করেছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে সবাই আসবেন। একজনও আসেননি। যোগাযোগও করেননি।’ খড়্গপুরের শ্রীকৃষ্ণপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবীপ্রকাশ নিয়োগী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও ভরসা রাখতে পারলেন না! ২ জন শিক্ষক ও ১ জন অশিক্ষক কর্মীর মধ্যে একজনও এলেন না।’ কেশপুরের গোলাড় সুশীলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরেশ পড়িয়া টেবিলে রাখা সপ্তম থেকে একাদশ শ্রেণির জীবন বিজ্ঞানের খাতার বান্ডিলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন, আজ বুঝি তার একটা গতি করা যাবে। ৩ এপ্রিল স্কুলের ৪ বিজ্ঞানের শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার পরে তাঁরা কেউ স্কুলে আসেননি। অগত্যা সহ-শিক্ষকরা সেই খাতার বান্ডিল তুলে দিলেন প্রধান শিক্ষকের হাতে।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘কী করতে পারি। দায়িত্ব তো আমারই। ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে যে কোনও ভাবে খাতা দেখার ব্যবস্থা তো করতে হবে। পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করতে হবে। জানি না, কী ভাবে স্কুল চালাব।’ স্কুলের ছাত্রী তৃষা মহন্ত, অন্তরা কুলধ্যায়, সুস্মিতা রানারাও তাকিয়েছিলেন গেটের দিকে, যদি ঢোকেন শিক্ষকরা! না-দেখতে পেয়ে হতাশ তাঁরাও। তাঁদেরও দাবি, যাঁরা এতদিন ভালো পড়ালেন, তাঁরা যেন স্কুলে আসেন। সুপ্রিম–নির্দেশে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ১৭০০ জনের চাকরি গিয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১৪০০ জন শিক্ষক। বাকিরা অশিক্ষক কর্মী।
এমনিতেই স্কুলে শিক্ষকদের শূন্যপদ ছিল অনেক। তার মাঝে এতজনের চাকরি যাওয়ায় স্কুল চালানোয় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল প্রধান শিক্ষকদের কাছে। তাই সকলে আশা করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরে সকলে না-হলেও হয়তো অনেকেই আসবেন। কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলেই একজনকেও দেখা গেল না। শুধুমাত্র শালবনি নিচমঞ্জরী বালিকা বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষিকা সুদেষ্ণা ভক্তা ও অদিতি চক্রবর্তী স্কুলে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, যোগ্যদের চাকরি যাবে না। আমাদের তো ভরসা রাখতে হবে।’ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বাসবী ভাওয়াল বলেন, ‘দুই শিক্ষিকা স্কুলে এসেছিলেন। কাজও করছেন।’