• লক্ষ টাকার মাইনে ছেড়ে শিক্ষকতায়, চাকরি খুইয়ে দিশেহারা দম্পতি
    বর্তমান | ১০ এপ্রিল ২০২৫
  • রাজদীপ গোস্বামী, মেদিনীপুর: একসঙ্গে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। মাস ফুরলে লক্ষ টাকারও বেশি বেতন। কিন্তু তাতেও মন ভরছিল না। ছোট বেলায় লালিত স্বপ্নটা মাঝে মধ্যেই চাগাড় দিয়ে উঠত দু’জনের মনের ভিতর। কারণ, দু’জনেরই স্বপ্ন ছিল একতারে বাঁধা। তাকে আঁকড়েই কলেজ জীবনে প্রেম। একসঙ্গে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া। স্বপ্নপূরণ হতেই সাতপাকে বাঁধা। এক ধাক্কায় সব শেষ! চাকরি খুইয়ে দিশেহারা ডেবরার দম্পতি। 

    ওই বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতে করতেই এসএসসি’র প্রস্তুতি শুরু করেন দু’জনে। রাতদিন পড়াশোনা করে বিরাট সাফল্য। ২০১৮ সালে সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে বেসরকারি সংস্থা ছেড়ে দেন। সেরে ফেলেন বিয়েটাও। প্রায় সাত বছর চাকরি করার পর জীবনে এভাবে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি ডেবরার ওই দম্পতি সুখেন্দুবিকাশ সামন্ত ও সৌমিতা ঘর। দুর্নীতির পাকচক্রে চাকরি খুইয়ে কপাল চাপড়াচ্ছেন দু’জনেই।  

    মঙ্গলবার বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আফসোস করছিলেন সুখেন্দুবাবু। বলছিলেন, ‘আমরা একসঙ্গে চাকরি ছেড়েছিলাম একটাই স্বপ্ন বুকে আঁকড়ে। চেয়েছিলাম স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের যত্ন করে পড়াব। কিন্তু, এতদিন পর এভাবে চাকরিটাই কেড়ে নেবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। নিজেদের বেশ অসহায়  লাগছে। কী করব ভেবে উঠতে পারছি না। এত বছর পর ফের বেসরকারি চাকরিতে ফিরে যাওয়াও কঠিন। বাড়িতে সন্তান রয়েছে। কিভাবে সংসার চালাব জানি না।’ সুখেন্দুবাবুর মুখের কথা একরকম কেড়ে নিয়ে স্ত্রী সৌমিতার সংযোজন, ‘সরকারি চাকরি করতে সকলেই চান। আমরা দু’জনেই এসএসসিতে ভালো র‌্যাঙ্ক করেছিলাম। দু’জনেই চেয়েছিলাম স্কুলে পড়াব। কেননা, বেসরকারি সংস্থার চেয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে সামাজিক সম্মান ঢের বেশি। আজ আমাদের শুধু চাকরিই যায়নি, আমাদের সামাজিক সম্মানও ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এখন একটাই আবেদন, সরকার যোগ্যদের কথা একবার ভাবুন। আমরা নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছিলাম।’ 

    সুখেন্দুবাবুর বাড়ি ডেবরা ব্লকের বালিচক এলাকায়। স্ত্রী সৌমিতার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলে। একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন দু’জনেই। ছোট থেকেই তাঁরা মেধাবী ছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেছিলেন। কলেজে পড়াকালীন সুখেন্দুবাবুর সঙ্গে সৌমিতাদেবীর পরিচয়। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দু’জনেই একইসঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। পড়াশোনা শেষ করে তাঁরা চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। ২০১৫ সাল নাগাদ একসঙ্গে একটি বড় বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে যান। বেশ ভালো পদেই চাকরি করতেন দু’জনে। মোটা অঙ্কের বেতনও পেতেন। কিন্তু শিক্ষকতার নেশায় এসএসসি দিয়ে কৃতকার্য হন। চাকরি পেতেই বেসরকারি সংস্থার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা দু’বারের জন্য ভাবেননি সুখেন্দু-সৌমিতা। এসএসসিতে ৩২ তম স্থান পেয়েছিলেন সুখেন্দুবাবু। সৌমিতাদেবীর ছিল ৬৮ তম স্থান। 

    সুখেন্দুবাবু বর্তমানে পিংলার গোপীনাথপুর দেবায়তন বিদ্যাপীঠ স্কুলের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক। সৌমিতাদেবী সবং এলাকার হরিরহাট অনাথ স্মৃতি গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। দু’জনের একটি সন্তান রয়েছে। চাকরি চলে যাওয়ায় দু’জনই হতাশ। সুখেন্দুবাবু বলছিলেন, ‘পিএইচডি করছি। সেটা কিভাবে সম্পূর্ণ করব বুঝতে করছি না।’ 

    সুখেন্দুবাবুর চাকরি চলে যাওয়ায় মহাফাঁপরে পড়েছে পিংলার গোপীনাথপুর দেবায়তন বিদ্যাপীঠও। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সনাতন শিট এদিন বলছিলেন, ‘স্কুলের অনেকেই অবসর নিয়েছেন। একজন ট্রান্সফার নিয়েছেন। এরমধ্যে দু’জন শিক্ষক চলে গেলেন। কিভাবে স্কুল চালাব বুঝে উঠতে পারছি না।’ একই অবস্থা সৌমিতাদেবীর স্কুলেও। 
  • Link to this news (বর্তমান)