কলকাতার বিচারভবনের গেটে ঠায় পাহারায় দিনভর, সন্ধ্যা নামলেই উর্দি ছেড়ে বিভিন্ন মন্দির চত্বরে গিয়ে শোনান রামপ্রসাদী গান!
বর্তমান | ১০ এপ্রিল ২০২৫
সুকান্ত বসু, কলকাতা: কথায় আছে যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। এই প্রবাদ বাক্যই খাটে দেবাশিস বড়ুয়ার ক্ষেত্রে। দেবাশিসবাবু একাধারে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেন, তেমনই তিনি গান ধরেন সন্ধ্যা নামলে। তবে যে সে গান নয়, খোদ রামপ্রসাদী। একেক দিন একেক মন্দিরের চাতালে বসে গলা ছেড়ে শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে শোনান তিনি। এই ভক্তিমূলক গান শুনতে সন্ধ্যার পর সেইসব মন্দিরে ভিড় জমায় ভক্তের দল।
প্রতিদিন কলকাতার বিচারভবনের মূল গেটে গেলেই দেখা মিলবে কনস্টেবল দেবাশিস বড়ুয়ার। কলকাতা রিজার্ভ ফোর্সে কর্মরত এই কনস্টেবলকে ছুটির দিন ছাড়া শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার যে কোনও দিনে পাওয়া যায় ওই গেটে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। ডিউটি শেষে সটান চলে যান বাড়ি। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে টিফিন সেরে সোজা চলে যান কলকাতার কোনও না কোনও মন্দিরে। শুরু হয় একাকী গানের আসর। রামপ্রসাদী গান গেয়ে একাই মাতিয়ে রাখেন তিনি। কখনও ধরেন ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না...’, পরক্ষণেই তাঁর কণ্ঠে শোনা যায়, ‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা...’। এভাবেই একের পর এক শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে ভক্তদের মন জয় করেন তিনি। তবে দেবাশিসবাবুর গলায় ‘ডুব দে রে মন কালী বলে...’ কিংবা ‘বসন পরো মা...’ যে আবেগ তৈরি করে, তা অনেক প্রথিতযশা শিল্পীকেও হার মানায়। তবে রবিবারের ছুটি একেবারেই তাঁর নিজস্ব। সেদিন তাঁর গলা সাধার দিন। সকালের দিকে সাংসারিক কাজ সারার পর চলে তালিম পর্ব। আবার সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে যান মন্দিরে।
তাঁর রামপ্রসাদী গান শুনতে আজও বহু মানুষ ভিড় জমান মঠ‑মন্দিরে। শুধু গান নয়, নানা বাদ্যযন্ত্রও তিনি বাজান অনায়াসে। সারাদিন উর্দি পরে পুলিসের কাজ করার পর কীভাবে নিজেকে সুর-সাধনায় ডুবিয়ে রাখেন? প্রশ্ন করতেই দেবাশিসবাবুর সহাস্য উত্তর, ‘ঠাকুর চাইলে সব কিছুই হয়। শুধু চাই প্রবল ইচ্ছা, আর একাগ্রতা। তাহলেই সব কাজ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।’ বেলায় বিচারভবনের গেটের কাছে কান পাতলে গুনগুনিয়ে ভেসে আসে গান। ডিউটি করতে করতেই খালি গলায় নিচু স্বরে রেওয়াজ চালিয়ে যান তিনি।
যাঁরা তাঁর গান শুনেছেন, তাঁদের অনেকেই খুশি হয়ে সম্মানিত করেছেন দেবাশিসবাবুকে। পেয়েছেন পুরস্কারও। কয়েক বছর আগে ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে গান শুনে তাঁকে স্মারক ও বই দিয়েছিলেন কলকাতার নগর দায়রা আদালতের তৎকালীন মুখ্য বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলাল। উর্দিধারী দেবাশিস বড়ুয়ার কথায়, গানই আমার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। আর এক বছর বাদেই ষাটে পড়বেন। সেদিন থেকে অখণ্ড অবসর। তখন গানের চর্চাই হয়ে উঠবে একমাত্র সম্বল। -নিজস্ব চিত্র