• লড়াইয়ের নাম প্রভাবতী, আলো দিচ্ছে তাঁর গড়া স্কুল
    এই সময় | ১০ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়, কুলতলি: শুরুটা হয়েছিল ৩৫ জনকে নিয়ে ১৭ বছর আগে। এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১১০ জন। নার্সারি থেকে ক্লাস ফোর। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা কুলতলির ৩৬ নম্বর মণ্ডলের লাটের মালপাড়ায় শশধর সর্দার স্মৃতি শিশু নিকেতন। অবৈতনিক। ওই খুদে পড়ুয়াদের পড়াশোনার দায়িত্বে ৮ জন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মহিলাও। শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে তিনি কেবল মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তাঁর অগাধ। এবং ওই স্কুল দেখলে বোঝার উপায় নেই পড়াশোনার প্রতি টানের জন্য কী নিপীড়ন, কী অত্যাচার হয়েছে প্রভাবতী মণ্ডলের উপর— এমনকী সে জন্য তাঁর শিশুকন্যার প্রাণ পর্যন্ত সংশয় হয়েছিল।

    এখন তা–ও অবস্থা কিছুটা ভালো, তবে কুলতলির প্রান্তিক ওই তল্লাটে সেই সময়ে শিক্ষা তেমন ছড়ায়নি। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল প্রভাবতীর। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, নামখানার একটি স্কুলে। কিন্তু তার পর তাঁর পড়াশোনা আর এগোয়নি। ২০০৬ সালে গ্রাম্য জীবনের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রভাবতীর বিয়ে হয় মন্দিরবাজার এলাকায়। তবে শ্বশুরবাড়িতে গেলেও দিদা কিরণ সর্দারের দান করা পাঁচ কাঠা জমিতে ২০০৮ সালে এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য তিনি শুরু করেন দাদু শশধর সর্দারের স্মৃতিতে ওই স্কুল। বাপের বাড়িতে স্কুল চালানো আর শ্বশুরবাড়িতে সংসার করা— এমনটাই চলল কিছু দিন। মা হলেন প্রভাবতী।

    তবে তার পরেই শুরু হলো পণের দাবিতে ওই তরুণীর উপর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার। পড়াশোনার প্রতি প্রভাবতীর আগ্রহ নিয়েও তীব্র আপত্তি শ্বশুরবাড়ির। প্রভাবতী জানাচ্ছেন, স্বামীর অত্যাচার ছিল লাগামহীন। এতটাই যে, তাঁর পর্যন্ত ভেঙে দেয় ওই ব্যক্তি। সেটাও সহ্য করেছিলেন ওই মহিলা। তবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়েকে যখন তাঁর স্বামী ছুড়ে ফেলে দিল বাড়ি সংলগ্ন ধানের, তখন আর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেননি প্রভাবতী। জলে ভরা ফসলের মাঠ থেকে কোনও রকমে মেয়েকে উদ্ধার করে তিনি চলে আসেন কুলতলির বাপের বাড়িতে। প্রভাবতী আর ফিরে যাননি তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। সেই ইস্তক শুরু হয় তাঁর জীবন সংগ্রাম, মেয়েকে বড় করে তোলা এবং শিক্ষার সাধনা।

    এখন প্রভাবতী ৩৮ বছরের। যার জন্য তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসা, সেই মেয়ে পড়ছে একাদশে। প্রভাবতীর দাদুর নামে তৈরি সেই স্কুলের আজ দোতলা বাড়ি, ১০টা ঘর। দোতলার ছাদ অ্যাসবেস্টসের। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং কয়েক জন সহৃদয় ব্যক্তির আর্থিক সাহায্যে ২০১৪ সালে ওই স্কুলবাড়ি তৈরি হয়। তবে স্কুল চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রভাবতীকে। একে নিজের অভাবের সংসার। তার উপর এত জন খুদে পড়ুয়া। বহু মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে, সাহায্য–সহযোগিতা নিয়েই কোনও রকমে চলছে ওই স্কুল। পড়ুয়াদের বই আনতে তিনি মাঝেমধ্যেই কুলতলি থেকে উজিয়ে যান কলেজ স্ট্রিটে। শিক্ষকদের জন্য বইয়ের যে সব স্যাম্পল কপি থাকে, সেগুলো তিনি তুলে দেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে। পড়ুয়াদের ওই স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়া হয়, আর্থিক সমস্যার কারণে সেটা অবশ্য অনিয়মিত।

    তবে প্রভাবতী মণ্ডলের হাতে গড়া ওই স্কুলের উপর স্থানীয় বহু অভিভাবকের অনেক ভরসা। তেমনই দুই অভিভাবক বিশ্বনাথ হালদার ও বিনোদ মাল বলছেন, ‘স্কুলে পড়াশোনার মান খুব ভালো। আমরা গরিব। কিন্তু বিনা পয়সায় স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতে পারছি। দিদিমণিরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ান। বাচ্চাদের বইপত্র, জামাকাপড়ও স্কুল থেকে দেওয়া হয়।’

    যাঁর গড়া স্কুল প্রান্তিক ওই তল্লাটে আলো দেখাচ্ছে, সেই প্রভাবতী মণ্ডল বলছেন, ‘জীবনে অনেক দুঃখ, কষ্ট পেয়েছি। শ্বশুরবাড়িতে সংসার করতে পারিনি। মেয়েটাকেও ছোটবেলায় অত্যাচার সইতে হয়েছে। তবে মেয়েকে আমি পড়িয়ে গিয়েছি।’ তাঁর সংযোজন, ‘আমার মেয়ের মতো এখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও যাতে পড়াশোনা করতে পারে, সেই চেষ্টাই করছি দাদুর নামে করা স্কুলটার মাধ্যমে। কষ্ট হচ্ছে। হোক।’

  • Link to this news (এই সময়)