• চাকরিহারাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ একাধিক জেলায়! বৈঠকে ডাকবেন শিক্ষামন্ত্রী, শান্ত থাকতে পরামর্শ মুখ্যসচিবের
    আনন্দবাজার | ১০ এপ্রিল ২০২৫
  • চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এই দাবি নিয়ে স্কুল পরিদর্শকের দফতরে গিয়েছিলেন চাকরিহারারা। কিন্তু সেখানে জুটল বুকে-পেটে লাথি, গলাধাক্কা! পুলিশের লাঠির ঘায়ে জখমও হলেন কয়েক জন। বুধবার কসবার স্কুল পরিদর্শক (ডিআই)-এর দফতরের ওই ঘটনায় যখন চারিদিকে নিন্দার ঝড়, তখন পুলিশ বিবৃতি দিয়ে জানাল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘বাধ্য হয়েই হালকা বলপ্রয়োগ’ করতে হয়েছে!

    নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরিহারাদের আশ্বাস দেওয়ার পরেও গোটা ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়ে মাঠে নামতে হয়েছে প্রশাসনকে। চাকরিহারাদের শান্ত, সংযত থাকার বার্তা দিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও জানালেন, চলতি সপ্তাহেই তিনি চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।

    বুধবার জেলায় জেলায় ডিআই দফতর অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন চাকরিহারারা। সকাল থেকেই জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়। কসবার ডিআই দফতরেও জড়ো হয়েছিলেন অনেকে। তাঁরা চেয়েছিলেন স্কুল পরিদর্শকের সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে স্মারকলিপি তুলে দিতে। কিন্তু স্কুল পরিদর্শক দফতরে ছিলেন না। অভিযোগ, ওই সময় আচমকাই কয়েক জন বিক্ষোভকারী ডিআই দফতরের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করায় তাদের সঙ্গেও বচসা শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তা গড়ায় ধস্তাধস্তি, হাতাহাতিতে। ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশ তাঁদের বেধড়ক মারধর করেছে। কাউকে মাটিতে ফেলে বুকে-পেটে লাথি মারা হয়েছে। কাউকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ছবি-ভিডিয়োও ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে। যদিও সেগুলির সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি। চাকরিহারা শিক্ষক প্রতাপ রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘আমরা যোগ্য, তাই চাকরিহারা হয়ে আজ রাজপথে আন্দোলন করছি। পুলিশ আমাদের নির্বিচারে লাঠি মেরেছে।’’

    পাল্টা পুলিশের দাবি, বিনা প্ররোচনায় একদল বিক্ষোভকারী পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে। হিংসাত্মক আচরণ করেছে। বিক্ষোভকারীদের হামলায় পুলিশেরও কয়েক জন জখম হয়েছেন। এর পরেই ‘বাধ্য হয়ে হালকা বলপ্রয়োগ’ করেছে পুলিশ। কসবার ঘটনায় ইতিমধ্যেই দু’টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। একটি অভিযোগ করেছেন ডিআই। অন্যটি পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে করেছে।

    কসবার ঘটনার পর বুধবার বিকেলে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, কলকাতা পুলিশের কমিশনার মনোজ বর্মা এবং রাজ্য পুলিশের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জাভেদ শামিম। বিক্ষোভকারী চাকরিহারাদের লাথি মারা নিয়ে মুখ্যসচিব অবশ্য সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘ওই ভাবে লাথি মারা কখনওই কাম্য নয়। পুলিশকর্মীদের বলাই হয়েছে, এ রকম যাতে কিছু না ঘটে।’’ কিন্তু সিপির বক্তব্য, যে ছবি-ভিডিয়ো দেখানো হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ নয়। আগে-পিছনে আরও কিছু রয়েছে। পুলিশেরও ছ’জন জখম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চার জন পুরুষ পুলিশকর্মী। দু’জন মহিলা। এক জন সার্জেন্ট গুরুতর জখম। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

    কসবার ঘটনাকে ‘অনভিপ্রেত’ বলেছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থও। তিনি বলেন, ‘‘সকলের কাছেই অনুরোধ, এমন পরিস্থিতি যেন আর তৈরি না হয়।’’ তবে মুখ্যসচিব জানান, কারও কথায় বা উস্কানিতে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা বা তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কাম্য নয়। সেখানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে বাধ্য হয়েই পুলিশকে ওই পদক্ষেপ করতে হয়েছে। চাকরিহারাদের আশ্বাস দিতে গিয়ে তিনি জানান, ইতিমধ্যেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সুপ্রিম কোর্টে স্থিতাবস্থা চেয়ে আবেদন করেছে। সরকারও শীঘ্রই রায় পর্যালোচনার আবেদন করবে শীর্ষ আদালতে। মনোজের কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনেই পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। সেখান থেকে আরও ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে সেইমতো আরও পদক্ষেপ করা হবে। সরকার এবং প্রশাসন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেই রয়েছে।’’

    চাকরিহারাদের কয়েক দিন ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য। তিনি জানান, চলতি সপ্তাহেই তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষা দফতরের সঙ্গে চাকরিহারাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। অন্তত ওই বৈঠক পর্যন্ত তাঁদের ধৈর্য ধরা উচিত। শিক্ষামন্ত্রীর কথায়, ‘‘এক দিকে বৈঠক, অন্য দিকে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।’’

    বুধবার জেলায় জেলায় একই ভাবেই পথে নেমেছিলেন চাকরিহারারা। হুগলিতে মিছিল করে ডিআই অফিসে যান তাঁরা। বিক্ষোভকারীদের দাবি, যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করে চাকরি ফেরাতে হবে। হুগলি মোড়ে জিটি রোড অবরোধও করা হয়। পরে ডিআই অফিসে গিয়ে গেটে তালা মেরে দেন বিক্ষোভকারীরা। মেদিনীপুর ডিআই অফিসের সামনেও বিক্ষোভ দেখান চাকরিহারারা। অভিযোগ, সেখানেও জেলা স্কুল পরিদর্শককে অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নদিয়ার কৃষ্ণনগরেও একই ছবি ধরা পড়েছে। টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে দফায় দাফায় বিক্ষোভ চলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশবাহিনী। মুর্শিদাবাদেও ডিআই অফিসের গেটে তালা ঝোলানো হয়। মালদহে চাকরিহারাদের ডিআই অফিস অভিযানকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধে। বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ ইংরেজবাজার শহরের অতুল মার্কেট সংলগ্ন স্কুল পরিদর্শকের দফতর ঘেরাও করে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী মঞ্চ। অভিযোগ, ডিআই অফিসের সামনে যেতেই তাদের আটকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে তাদের ধস্তাধস্তিও হয় পুলিশের সঙ্গে। একই ছবি বালুরঘাটেও দেখা গিয়েছে।

    অভিজিতের ‘প্রতিবাদ’

    কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে লেখা চিঠি তিনি তুলে দেবেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যের হাতে, তাঁর দফতরে গিয়ে। কিন্তু তার আগেই প্রকাশ্যে সে চিঠি ছিঁড়ে ফেললেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। জানিয়েছিলেন, কসবার ঘটনার প্রতিবাদেই তিনি ব্রাত্যের দফতরে যাননি এবং চিঠিও দেননি। তবে তিনি এসএসসি দফতরে গিয়েছিলেন। যদিও বিজেপির অন্দরের খবর, দলের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই সম্পূর্ণ একার সিদ্ধান্তে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না-করার মর্মেই রাজ্য বিজেপির দুই শীর্ষনেতার বার্তা গিয়েছিল অভিজিতের কাছে। বিশেষত, দলের বাকি সদস্যেরা যখন রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কড়া রাজনৈতিক আক্রমণে যাচ্ছেন। অভিজিৎ যা করতে চেয়েছিলেন, তাতে বিরোধী দলের ‘রণং দেহি’ মনোভাবটাই মিইয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অন্তত তেমনই মনে করে রাজ্য বিজেপির বড় অংশ। কারণ, যে মমতাকে গোটা দল চাকরিহারা শিক্ষকদের দুর্গতির জন্য কাঠগড়ায় তুলছে, সেই মমতাকেই কমিটি গঠনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখে বসেছেন অভিজিৎ। শুধু লেখাই নয়। শিক্ষামন্ত্রীর মারফত সেই চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানোরও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন! সেই মর্মে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। বস্তুত, অভিজিৎ যখন তাঁর পূর্বঘোষিত এবং একক কর্মসূচি অনুযায়ী এসএসসি দফতর হয়ে বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছেন, তখন রাজ্য বিধানসভায় তাঁর সতীর্থেরা লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পথ অবরোধ করছেন। অভিজিৎ যখন মমতার মন্ত্রিসভার সদস্য ব্রাত্যের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, প্রায় তার পিঠোপিঠি সময়ে পূর্ব মেদিনীপুরের রেয়াপাড়ায় একটি সভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, ‘‘উনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। চোর বন্দ্যোপাধ্যায়!’’ দু’টি ঘটনাপ্রবাহ পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত, যা বিজেপির পক্ষে ‘অস্বস্তিজনক’। কিন্তু অভিজিৎ তত ক্ষণে এগিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে রয়েছে সংবাদমাধ্যম। রয়েছেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি অংশ। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছে বুঝে রাজ্যের দুই শীর্ষনেতার হস্তক্ষেপেই শেষরক্ষার (বা মুখরক্ষা) পথ খোঁজা শুরু হয়। যার উপসংহার মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিটি সর্বসমক্ষে ছিঁড়ে ফেলা।

    অভিজিৎকে কটাক্ষ ব্রাত্যের

    অভিজিৎ যে ব্রাত্যের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন না, তা বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। এর পরেই ব্রাত্য বলেন, ‘‘উনি নিজেই আমার কাছে মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠি জমা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে জানিয়েছেন, তিনি আসবেন না। কসবার ঘটনার প্রতিবাদে আসেননি, এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। শিক্ষা দফতর পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত নয়। তা ছাড়া, এখানে এলেন না, কিন্তু এসএসসি দফতরে গেলেন? ওটাও তো সরকারি অফিস!’’ শিক্ষামন্ত্রীর আরও মত, অভিজিতের না আসার নেপথ্যে ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘উনি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিতে চাওয়ায় দলীয় রাজনীতিতে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হল কি না, দল ওঁকে বারণ করল কি না, সে সব উনিই বলতে পারবেন!’’ ‘রাজনীতি’-অস্ত্রের পর অভিজিৎকে বিঁধতে পুরনো পল্লিগানও উদ্ধৃত করেছেন ব্রাত্য। তিনি বলেন, ‘‘আমার একটি কবিতা মনে পড়ছে— তুমি সর্প হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো! ওঁর বিষয়টা খানিকটা সে রকম।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)