সি আর পার্কের মাছের বাজার নিয়ে তরজা, পরিকল্পনা করেই ভিডিয়ো পোস্ট মহুয়ার, বলছে গেরুয়া শিবির
আনন্দবাজার | ১০ এপ্রিল ২০২৫
মাছে ভাতে বাঙালি। রাজধানীর মিনি কলকাতা বলে পরিচিত চিত্তরঞ্জন পার্কের সেই বাঙালির পাত থেকে মাছ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে গেরুয়া শিবির, এই অভিযোগে সরব হলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর মার্কেটের মাছের বাজারের সঙ্গেই রয়েছে কালীমন্দির। কেন মন্দিরের সঙ্গেই মাছের বাজার, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গেরুয়া শিবির। মাছের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তড়িঘড়ি যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে বিজেপির দাবি, চাকরি দুর্নীতি, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে নজর ঘোরাতেই মাছ নিয়ে ওই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে তৃণমূল।
বিজেপি এই দাবি করলেও, কে কী খাবে সেই ফরমান অবশ্য মোদী সরকার আসার পর থেকেই আকছার দিতে দেখা গিয়েছে গেরুয়া বাহিনীকে। গত কিছু বছরে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে আমিষ খাবারের স্টল কেন থাকবে, তা নিয়েও মণ্ডপ কর্তাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এ বার সরাসরি মাছের বাজার তুলে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসলে বাঙালি আবেগকে আঘাত করা হয়েছে বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাঙালি সমাজ। চিত্তরঞ্জন পার্কের স্থানীয় বাসিন্দা ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে জাতের ফুটবলের লড়াই হয় ইলিশ-চিংড়ি নিয়ে, সেই মেছো বাঙালির মাছের বাজার তুলে দেওয়ার হুমকি কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’’ অন্য দিকে, বিতর্কের খবর পেয়েই আজ সকালে ওই বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খান। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া থেকে নজর ঘোরাতেই মহুয়া মৈত্র পরিকল্পিত ভাবে ওই ভিডিয়োটি ছেড়েছেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাজার যেমন আছে তেমনই থাকবে।’’
মূল বিতর্কের সূত্রপাত গত কাল। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র একটি ভিডিয়ো টুইট করেন। যাতে গেরুয়া বাহিনীর দুই সদস্যকে চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর মার্কেটের মাছের বাজারে দেখা যায়। যুবকদের বক্তব্য, এতে মন্দিরের শুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে। কেন মাছের বাজারের সঙ্গে মন্দির থাকবে তা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি আমিষ খাওয়া কেন শাস্ত্রবিরোধী, সেই ব্যাখ্যা দিতেও দেখা যায় ওই দু’জনকে। যুবকেরা স্বঘোষিত ‘সনাতনী’, তাই মন্দির লাগোয়া মাছের বাজার বন্ধ করার দাবিও তোলে তারা। বাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, ওই মাছের বাজার বন্ধের দাবি জানিয়ে চলতি সপ্তাহে একটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে বলে শুনেছেন তাঁরা। অথচ বাজার বৃদ্ধির সঙ্গেই আড়ে-বহরে ও জৌলুসে বেড়েছে ওই মন্দির। এখন মন্দিরের কারণে যদি বাজার বন্ধের মতো পরিস্থিতি হয়, সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে হাজার খানেক ব্যক্তির জীবন প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আজ দুপুরে ওই মাছের বাজারের সর্বত্র একই গুজগুজ-ফুসফুস। কথা হচ্ছিল ব্যবসায়ী দিব্যেন্দু দাসের সঙ্গে। ছয় দশকের কাছাকাছি পারিবারিক মাছের ব্যবসা। একপাশে ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে পমফ্রেট। ট্যাংরা-পার্শের সঙ্গেই বরফের চাঙড়ের তলায় সহবস্থান কুঁচো ও গলদা চিংড়ির। চৈত্রের দুপুর। তাই বেচাকেনা কম। দিব্যেন্দু জানালেন, ‘‘ওই ছেলেগুলি মাসখানেক আগেও এসেছিল। যে ভিডিয়োটি ভাইরাল হয়েছে সেটি ৩১ মার্চের তোলা। সে সময়ে নবরাত্রি চলছিল।’’ উত্তর ভারতের হিন্দুদের একটি বড় অংশ বছরে দু’বার নবরাত্রির সময়ে আমিষ খাওয়া বন্ধ রাখেন। তাই নবরাত্রির কথা মাথায় রেখে বিষয়টি ঘাঁটাননি বলে জানালেন আর এক ব্যবসায়ী সজল দাস। সে সময়ে ধামাচাপা পড়ে গেলেও, ফের গত কাল ওই বিতর্কিত ভিডিয়োটি টুইট করে বিষয়টি উস্কে দেন মহুয়া। সজলের মতে, ‘‘এতে এক দিকে ভাল হয়েছে। অনেকে গিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।’’ আপের প্রাক্তন বিধায়ক সৌরভ ভরদ্বাজ বলেন, ‘‘নবরাত্রিতে বাঙালিরা আমিষ খেয়ে থাকেন। সেটাই তাঁদের ঐতিহ্য। এখন বাঙালি সংস্কৃতিতে থাবা বসানোর চেষ্টা করছে বিজেপি।’’
সনাতনীদের তোলা ওই ভিডিয়ো কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বকেও। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মধ্যে এই আমিষ বিতর্ক ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন বিজেপি নেতারাই। ফলে তড়িঘড়ি ক্ষত মেরামতিতে নেমেছে দল। মাছের সঙ্গে বাঙালির একাত্মতা প্রশ্নাতীত বুঝেই সকাল সকাল ওই সনাতনীদের নিন্দায় সরব হয়েছেন দিল্লি বিজেপির সভাপতি বীরেন্দ্র সচদেব। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, ‘‘মাছের ব্যবসায়ীরা বরাবর মন্দিরের পবিত্রতা বজায় রেখে এসেছেন। মূলত এলাকার শান্তি নষ্ট করতেই মহুয়া মৈত্রেরা পরিকল্পিত ভাবে ভিডিয়োটি বানিয়েছেন।’’ তিনি পুলিশকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন। আজ সকাল থেকেই মন্দির ও বাজার চত্বরের সমস্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু করেছে দিল্লি পুলিশের একটি দল। কারা কোন উদ্দেশ্যে ওই ভিডিয়ো বানিয়েছে, সেটা খোঁজাই প্রাথমিক লক্ষ্য বলে জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ।
উল্টো দিকে সরব বিরোধীরাও। আজ চিত্তরঞ্জন পার্কে যা হয়েছে কাল তা পশ্চিমবঙ্গেও হতে পারে বলে অভিযোগ তুলছেন তাঁরা। তৃণমূলের এক সাংসদের কথায়, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সবার আগে এরা আমিষ পদে নিষেধাজ্ঞা জারি যে করবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়?’’ এ দিকে আজ সমাজমাধ্যমে মাছের ডিম দিয়ে বানানো ফ্রায়েড রাইসের ছবি পোস্ট করে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন লেখেন, ‘‘এটা আমার মধ্যাহ্নভোজ। মাছের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করি না।’’ একই সঙ্গে এক মাস আগে তৃণমূলের
ফেসবুকে পোস্ট করা একটি স্লোগানকেও সামনে নিয়ে এসেছেন ডেরেক। তা হল, ‘মা, মাটি, মানুষ ও মাছ’। সম্প্রতি রাজ্যসভায় এ নিয়ে সরব হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আজ ডেরেক জানিয়েছেন, এর পরে যখনই তিনি সংসদীয় স্থায়ী
কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি যাবেন, তখন একটি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন, যাতে মুখ্য পদ হবে মাছের ডিমের ফ্রায়েড রাইস।