• একযোগে সরব বিরোধীরা, আরও প্রতিবাদের ডাক
    আনন্দবাজার | ১০ এপ্রিল ২০২৫
  • মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্য সরকার ‘মানবিক’ ভাবে চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশে আছে। ডিআই দফতরের বাইরে চাকরিহারাদের উপরে পুলিশের লাঠি, লাথি, ধাক্কার পরে রাজ্য সরকারের আশ্বাস এবং ভূমিকা নিয়েই একযোগে সরব হল বিরোধীরা। ঘটনার প্রতিবাদে বুধবারই বিক্ষোভে নেমে পড়েছে বিজেপি। অন্য দুই বিরোধী বাম ও কংগ্রেসের তরফে আজ, বৃহস্পতিবার পথে নামার ডাক দেওয়া হয়েছে। চাকরিহারা শিক্ষকেরাও আজ প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি নিয়ে‌ছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকমীর চাকরি বাতিলের জেরে যে ক্ষোভের আবহ ছিল, সেই বাতাবরণ আরও তেতে উঠল সব মিলিয়ে।

    সরকার তথা শাসক দলের তরফে অবশ্য ফের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, সমাধান সূত্র বার করার চেষ্টা চলছে। তাদের অভিযোগ, বিরোধীরা চাকরিহারা শিক্ষকদের একাংশকে ‘উস্কানি’ দিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, ‘‘ওঁরা (শিক্ষক) আমাদের সঙ্গে বসতে চাইছেন, আবার ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করছেন। দু’টো একই সঙ্গে তো হতে পারে না!’’ চলতি সপ্তাহেই শুক্রবার বা শনিবার তিনি ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘তবে আমি একা বসব না। স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) চেয়ারম্যান থাকবেন, আমার বিভাগীয় সচিব থাকবেন। শিক্ষা দফতরের অন্য কর্তারা থাকবেন। বসে একটা সুরাহা বার করার চেষ্টা হবে। মূল দাবিগুলো শুনব।’’

    তবে কসবায় ডিআই দফতরে চাকরিহারা শিক্ষকদের পুলিশের লাঠি মারার প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘‘পুলিশ কী করেছে, পুলিশের নিশ্চয়ই একটা বক্তব্য আছে। আমি কোনও মন্তব্য করতে পারি না। পুলিশকে জিজ্ঞেস করুন।’’ এর পরেই ব্রাত্য বলেন, ‘‘নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রী ওঁদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। সরকার সাহায্য করছে, সেখানে এই সব লড়াই-আন্দোলন স্থগিত রাখা যেত। এগুলোর জন্য দিন পড়ে আছে। তবে ওঁরা তালা ভাঙুন বা যা-ই করুন, আমরা বদ্ধ পরিকর ওঁদের পাশে থাকার।’’

    বিরোধীরা অবশ্য সরকারের আশ্বাস-বাণী শুননে নারাজ। তমলুকে এ দিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘একটাই কথা বলব। লাঠি-লাথি মারা সরকার, আর নেই দরকার! শিক্ষকদের পুলিশ লাঠি মারছে, লাথি মারছে। অমানবিক অত্যাচার করেছে। বর্বর কাজ করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আমাদের দলের বহু বিধায়ক গ্রেফতার হয়েছেন। আগামী দিনে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’’

    বিধানসভায় বিজেপির দলীয় সচেতক শঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে এ দিন ৮ জন বিধায়কদের একটি দল লালবাজারে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছিল। ছিলেন অগ্নিমিত্রা পাল, অশোক দিন্দা, সৌমেন রায়েরা। পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে। প্রতিবাদে বিজেপির উত্তর কলকাতা সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে লালবাজারের ফটক আটকে বসে পড়েন। তাঁকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। সন্ধায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। নিয়োগ-দুর্নীতির প্রতিবাদে এ দিনই ধর্মতলার গান্ধী মূর্তির নীচে সংগঠনের রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁয়ের নেতৃত্বে অবস্থান-বিক্ষোভ করে ভারতীয় জনতা যুব মোর্চা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, “আজ বাংলার শিক্ষা জগতের কালো দিন। কোথায় ছিল আইন, যখন ওয়াকফ নিয়ে তাণ্ডব হল?’’

    শিক্ষকদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদে আজ রাজ্য জুড়ে সব মানুষকে পথে নামার আহ্বান জানিয়েছে সিপিএম। দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল করবে বামফ্রন্ট। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘শিক্ষা ধ্বংস করা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা হচ্ছে। রাস্তায় নামা জরুরি। আজই প্রতিবাদ হচ্ছে। সব অংশের কাছে আবেদন কাল সর্বত্র প্রতিবাদে নামুন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে চাকরি গিয়েছে। হকের চাকরির দাবি তুললে লাঠিপেটা করতে হবে! লাথি মারতে হবে!’’ মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করেই সিপিএমের যুব নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘প্রথমে দুর্নীতি করে যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি কেড়েছে। এখন চাকরিহারা, আন্দোলনকারী যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করছে। বাংলা কি এমন ‘মানবিক’ মেয়েকেই চেয়েছিল?’’

    শিক্ষকদের উপরে পুলিশের হামলার প্রতিবাদেই এ দিন বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি দিতে যাননি বিজেপি সাংসদ ও প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা তাঁর একটা চিঠি শিক্ষামন্ত্রীকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এসএসসি দফতরে গেলেও তিনি বিকাশ ভবনে যাননি। এই প্রসঙ্গে ব্রাত্যের মন্তব্য, ‘‘উনি নিজেই আমার কাছে আসতে চেয়েছিলেন। দলীয় পরিচয় ভুলে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে আবেদন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এলেন না। আমার একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে, ‘তুমি সর্প হয়ে দংশন করো ওঝা হয়ে ঝাড়ো!’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘উনি আমার কাছে এলে দলীয় ভাবে কোনও বিপাকে পড়তেন কি না, দল ওঁকে বারণ করল কি না, উনিই বলতে পারবেন। তবে আমরা ওঁর জন্য বসেছিলাম।’’

    আমেদাবাদে এআইসিসি-র অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার পুলিশের আচরণের নিন্দা করে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যখন নেতাজি ইন্ডোরে চাকরিহারাদের নিয়ে বৈঠক করে বললেন, তিনি মানবিক ভাবে বিষয়টি দেখছেন। তার পরেও পুলিশ এই আচরণ করল কেন? পুলিশমন্ত্রীর নাম তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সমস্যা সমাধানের ইচ্ছে থাকলে অনেক রকম উপায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন, রাজ্য সরকারকে উত্তর দিতে হবে।” কলেজ স্কোয়ার থেকে আজ প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছে কংগ্রেস। ঘটনার নিন্দা করে ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’র রাজ্য সম্পাদক চঞ্চল চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কী রকম ভাবে চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশে আছেন, তারই নমুনা দেখালেন!’’

    অন্য দিকে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের একাধিক শাখা সংগঠন পথে নেমেছে চাকরি বাতিলে ‘সিপিএম-বিজেপির যড়ষন্ত্রে’র অভিযোগ তুলে। কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিরাট মিছিলে অংশ নেন দলের যুব ও ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মিছিলে সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবি-সহ প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘চাকরি খেকো বিকাশ ভট্টাচার্য!’ যুব তৃণমূলের সভাপতি সায়নী ঘোষ ও ছাত্র সংগঠনের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য-সহ দুই সংগঠনের নেতা ও একাধিক বিধায়ক, কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন। মেদিনীপুরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেছেন, ‘‘চাকরিহারা শিক্ষকদের বলছি, বিকাশ ভট্টাচার্য, সুকান্তবাবু, শুভেন্দুবাবুর গ্যাস খাবেন না! আপনাদের যখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, স্কুলে যান, পড়ান, দায়িত্ব আমার।‌ তখন স্কুলে গিয়ে পড়ান। মুখ্যমন্ত্রীর উপর ভরসা রাখুন।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)