মমতার ব্যক্তিগত জীবন তুলে বাঙালিকে প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির! নিন্দার ঝড়ে শেষে মুছে দিলেন পোস্ট
আনন্দবাজার | ১০ এপ্রিল ২০২৫
তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেন। তা নিয়ে বিতর্ক হয়। তার পর তিনি সেই পোস্ট মুছে দিয়ে পিছু হটেন। গত পাঁচ বছর ধরে এ-ই তাঁর রুটিন। সেই ধারাবাহিকতায় নবতম সংযোজন ঘটালেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন তুলে বাঙালির উদ্দেশে একটি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই সেই পোস্ট উধাও হয়ে গিয়েছে তাঁর সমাজমাধ্যমের পাতা থেকে। মনে করা হচ্ছে, সেটি তিনি মুছে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অতীতেও যেমন বহু বার করেছেন। তবে পোস্ট উধাও হলেও ওই মন্তব্য নিয়ে তৃণমূল তো বটেই, বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনীতি করা বিজেপি, সিপিএম-ও প্রাক্তন বিচারপতির নিন্দায় সরব হয়েছে। ঘটনাচক্রে, প্রাক্তন বিচারপতি মমতাকে জড়িয়ে যে কথা লিখেছিলেন, অতীতে সিপিএম, বিজেপির অনেক নেতা মমতার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সেই ধাঁচেরই নানা মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
প্রাক্তন বিচারপতি বুধবার রাতে সমাজমাধ্যমে পোস্টটি করেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ওই পোস্টের স্ক্রিনশট পোস্ট করে লিখেছেন, ‘‘এটা যদি সত্যিই এই ব্যক্তির বক্তব্য হয় এবং তিনি যদি ক্ষমা চেয়ে ডিলিট না করেন, তাহলে ইনি যে পদেই থেকে থাকুন, বাংলায় পা রেখেছেন খবর পেলে সামনে গিয়ে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মারব!’’ ঘটনাচক্রে বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টার পর থেকে প্রাক্তন বিচারপতির সমাজমাধ্যমের প্রোফাইলে ওই পোস্টটি আর দেখা যাচ্ছে না। মনে করা হচ্ছে, সমালোচনার কারণেই তিনি তা মুছে দিয়েছেন। যেমন অতীতেও বহু বার করেছেন। ঘটনাচক্রে, প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার বড় পদে থাকাকালীনও নানা বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ৭৮ বছর বয়সি ওই প্রাক্তন বিচারপতি। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি ক্ষমা চাননি।
এর আগে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর পরে তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী এবং বাঙালিদের জড়িয়ে সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ওই প্রাক্তন বিচারপতি। বিতর্ক তৈরি হয়েছিল হাথরস-কাণ্ডের পরে তাঁর মন্তব্য ঘিরেও। হাথরসের পরে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘নিশ্চয়ই অন্যায় হয়েছে। তবে পুরুষমানুষের এত দোষ ধরলে হয় না।’’ দু’টি ক্ষেত্রেই পরে পোস্টগুলি উধাও হয়ে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ওই প্রাক্তন বিচারপতি জন্মসূত্রে কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং লখনউয়ের ভূমিপুত্র।
প্রাক্তন বিচারপতির ওই মন্তব্য নিয়ে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই ধরনের মন্তব্যকে আমি অশ্লীলতা বলে মনে করি। রোয়াকে বসে কেউ কেউ যা বলেন, তা এই ধরনের মানুষের মুখে সমীচীন নয়।’’ রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার রুচি আমার নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলা যায়।’’ কংগ্রেস নেতা সুমন রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা সময়ে বিরোধী নেতাদের নাম, পদবি, চেহারা নিয়ে নানা কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি মনে করি, কখনওই ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে এনে আক্রমণ করা শিষ্টাচার নয়। কংগ্রেস এই সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না।’’
তবে অতীত বলছে, সিপিএম বা বিজেপি নেতাদের ঝুলিতে মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের রেকর্ড কম নেই। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের সময়ে মমতার উদ্দেশে কুরুচিকর আক্রমণ করায় সিপিএম ‘সেন্সর’ করেছিল প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুকে। অধুনাপ্রয়াত সিপিএম নেত্রী শ্যামলী গুপ্ত রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে একটি সভায় বলেছিলেন, ‘‘মমতা কোনও দিনও মা হতে পারেননি বলে উনি মায়ের যন্ত্রণা বোঝেন না।’’ ২০২১ সালের ভোটে নন্দীগ্রামে পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন মমতা। কয়েক দিন এসএসকেএমে ভর্তি থাকার পরে তৃণমূলনেত্রী বেরিয়ে পড়েন সারা রাজ্যের ভোটপ্রচারে। ভাঙা পায়ে প্লাস্টার নিয়ে হুইলচেয়ারে বসে সভা করতেন মমতা। সেই পর্বে বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘শাড়ি ছেড়ে বারমুডা পরুন দিদি!’’ ওই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও দিলীপ অনড় ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘আমি কিছু ভুল বলিনি। মানুষের কাছে গিয়ে শাড়ি সরিয়ে পা দেখানো কোনও ভদ্রতা নয়। তার চেয়ে বারমুডা পরা ভাল।’’ তবে সুজন এবং শমীক কেউই নিজেদের দলের নেতাদের পুরনো বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।
মমতার উদ্দেশে এই ধরনের আক্রমণ নতুন নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে, যত এই ধরনের আক্রমণ হয়েছে, মমতার ভোটের বাক্সে মহিলা সমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বুঝতে পেরে লিখিত ভাবে দলীয় নথিতে ‘পাপস্খালন’ করতে হয়েছিল সিপিএমকে। আরজি কর আন্দোলন পর্বে সিপিএম প্রকাশিত ‘মেয়েদের লড়াই’ শীর্ষক পুস্তিকায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট লিখেছিল, ‘‘কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি অদ্ভুত পোস্ট করে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রীর কম বয়সের ছবি পোস্ট করে তাঁরা মন্তব্য করেন যে, এই ছবি যদি ঠিক সময়ে পাত্রপক্ষের হাতে যেত, তা হলে আজ রাজ্যের এই রকম অবস্থা হত না। অর্থাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি গৃহবধূ হয়েই থেকে যেতেন, যদি রাজনীতির ময়দানে না আসতেন, তা হলে আজ রাজ্যের এই রকম অবস্থা হত না। এই মন্তব্যের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ থাকলেও এটি একটি অত্যন্ত জঘন্য পিতৃতান্ত্রিক বয়ান। এক জন মহিলাকে রাজনীতির ময়দান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরে আটকে রাখার পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা।’’ প্রাক্তন বিচারপতির দৌলতে রাজনৈতিক মহলের আলোচনায় ফিরে ফিরে আসছে রাজ্যের বিরোধী নেতাদের মন্তব্যও। যে সব দলের নেতারা এখন নিন্দায় সরব।