সংবাদদাতা, নবদ্বীপ: শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মিলনক্ষেত্র নবদ্বীপ। তাই চৈত্র মাসে নবদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী শিব মন্দিরগুলিতে বিভিন্ন বয়সের অনেকে গাজনের সন্ন্যাসী হন। এখন অনেক মহিলাও গাজন উপলক্ষ্যে সন্ন্যাসী হচ্ছেন। নবদ্বীপের বিখ্যাত সাত শিব মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৫০০ বছরেরও প্রাচীন বুড়োশিব, ঐতিহ্যবাহী যোগনাথ শিব, বালকনাথ শিব, দণ্ডপাণি শিব, বাণেশ্বর শিব,আলোকনাথ শিব এবং পলকেশ্বর শিব।
এই বিখ্যাত সাত শিব মন্দিরে চৈত্র মাসে কয়েকশো সন্ন্যাসী গাজন উৎসবে মেতে ওঠেন। এই মাসকে শিবের ‘ব্রতমাস’ বলা হয়। পাশাপাশি, নবদ্বীপের গ্রামীণ এলাকার বেশ কয়েকটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিব মন্দির, যেমন মাজদিয়া গাজনতলার হংসবাহন শিব মন্দির, ইদ্রাকপুর গাজনতলার শিব মন্দিরেও মহাসমারোহে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, যাঁরা এই ব্রত পালন করেন, প্রতিটি শিব মন্দিরের প্রধান সন্ন্যাসী তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন। নিয়মরক্ষায় এই ক’দিন কেউ বাসন্তী, কেউ গেরুয়া, কেউবা লাল রংয়ের বস্ত্র পরেন। গলায় থাকে গামছা। অনেকের গলায় থাকে রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে ত্রিশূল, কমণ্ডলু। সন্ন্যাসীরা সারাদিন শিবের নামে নির্জলা উপবাস থাকেন। গঙ্গায় স্নান সেরে সকাল-সন্ধ্যায় শিবলিঙ্গের মাথায় গঙ্গাজল, ফুল, বেলপাতা নিবেদন করেন। রাতে নিয়ম করে মাটির পাত্রে হবিষ্যি রান্না করেন। চৈত্র মাসের শেষদিনে নিয়মভঙ্গ করেন সন্ন্যাসীরা। যোগনাথ শিবের সন্ন্যাসী স্বপন সিংহ, পিন্টু দাস, অপূর্ব দাস, কালু দেবনাথ এবং মৌমিতা রায়রা জানান, তাঁরা কেউ ২৫, কেউবা ১০ বছর ধরে সন্ন্যাসী হচ্ছেন।
যোগনাথ শিবের প্রধান সন্ন্যাসী বাবুলাল গোস্বামী বলেন, এবছর নবদ্বীপে বিভিন্ন শিব মন্দিরে প্রায় সাতশোর বেশি সন্ন্যাসী হয়েছেন। যোগনাথ মন্দিরে গাজন অর্থাৎ নীলের সন্ন্যাসী হয়েছেন ২৭৫জন। এখানে প্রায় ২৫জন মহিলাও নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে এই সন্ন্যাস ব্রত পালন করছেন। চৈত্র মাসের গাজনের ক’দিন আমরা বাবাকে বিভিন্ন রূপে শৃঙ্গার করি। অর্থাৎ, বাবাকে প্রতিদিন বিভিন্ন রূপে সাজানো হয়। কোনওদিন মহাকাল, কোনওদিন নাগেশ্বর, কোনওদিন আবার শিব ও কালী এবং কোনওদিন জগন্নাথ ও মহাপ্রভু রূপে সাজানো হয় বাবাকে। আমরা এটাই ভক্তদের বোঝাতে চাই, যিনি কালী, তিনিই কৃষ্ণ। দেবতার বিভিন্ন রূপ হলেও, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বময় কর্তা একজনই।
ইদ্রাকপুর গাজনতলা শিব মন্দিরের গাজন উৎসবে সন্ন্যাসী হয়েছেন নবদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি তাপস ঘোষ। তিনি বলেন, প্রায় ৩২বছর ধরে গাজনের সন্ন্যাসী হয়ে আসছি। তবে এই ক’দিন জনসংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি না। একজন জন প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিদিন অফিসও করছি।
বৃহস্পতিবার সাত গাজন, অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী সাত শিবের স্নান। বিকেলে যে যার মন্দির থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র পোড়ামাতলায় একসঙ্গে মিলিত হবে। পরের দিন শিবের নাম করে সন্ন্যাসীরা একে অপরের সঙ্গে কাঁটা খেলবে। কাঁটা খেলার পরের দিন হয় ফল। এই ফলের দিন বাবা শিবকে ভক্তদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।