এই সময়: আইনি পথে চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের স্কুলে যাওয়া ও বেতন নিশ্চিত করার দাবিতে বুধবার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকদের (ডিআই–মাধ্যমিক) অফিস অভিযানের ডাক দিয়েছিল ‘যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’। কলকাতার কসবায় ডিআই অফিসে তাঁদের আন্দোলনে আচমকাই নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। চাকরিহারা শিক্ষক অমিতরঞ্জন ভুঁইয়াকে লাথিও মারেন এক পুলিশ অফিসার।
প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মহামিছিলের ডাক দিয়েছিল মঞ্চ। তাতে মধ্য কলকাতা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তিন হাজার শিক্ষক–শিক্ষিকা মিছিলে সামিল হন। আজ, শুক্রবার দুপুর ১২টায় আবার তাঁরা সল্টলেক করুণাময়ী থেকে এসএসসি ভবন অভিযানের ডাক দিয়েছেন। তার পর দুপুর দুটোয় বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা তাঁদের। সেখানে ব্রাত্য ছাড়াও শিক্ষাসচিব, স্কুলশিক্ষা–সচিব, স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) চেয়ারপার্সন এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতিরও থাকার কথা। চাকরিহারাদের লাগাতার আন্দোলন সম্পর্কে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে ব্রাত্য বলেন, ‘আন্দোলন নয়, কাজে ফিরুন। শিক্ষকরা ক্লাসে গেলে তাঁদেরই সুবিধা। আলোচনা ও আন্দোলন, দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।’
রাজ্যের আর এক মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম আবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘মাস্টারমশাইদের যখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন স্কুলে যেতে তখন তাঁরা ডিআই অফিস দখল করতে যাবেন কেন? ওঁরা তো নিজেদের মামলাটাকেই উইক করে দিচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্ট তো বলবে, আপনারা নথি নষ্ট করেছেন। যাঁদের প্ররোচনায় এ সব করছেন, তাঁরা কোনও সাহায্য করতে পারবেন না। সুজন চক্রবর্তী, সুকান্ত মজুমদাররা কিছু করতে পারবেন না। আপনাদের নিজেদের ক্ষতি হয়ে যাবে, সেটা বুঝুন।’
যদিও চাকরিহারারা এ সব কথায় বিশেষ আমল দিতে চাইছেন না। তাঁরা লাগাতার আন্দোলনের কথাই বলছেন। দিল্লির যন্তরমন্তরেও অবস্থান–বিক্ষোভের পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। রাজ্যের পাশাপাশি দেশের আমজনতাকেও নিজেদের দুর্দশার কথা জানাতে চান তাঁরা। ‘যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’–এর তরফে সঙ্গীতা সাহা বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে ১৭ এপ্রিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশনের শুনানি হওয়ার কথা। তার আগের দিন ১৬ এপ্রিল মঞ্চের তরফে বিক্ষোভ দেখানো হবে যন্তরমন্তরে। ওখানে ১৫০ জনের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। ১৬ এপ্রিলের আগে কলকাতায় লাগাতার কর্মসূচি চলবে।’
সেই লাগাতার কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে বৃহস্পতিবার যে মিছিল হলো, তাতে মধ্য কলকাতা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বুধবার কসবায় পুলিশি নিগ্রহের শিকার অমিতরঞ্জনও মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মন্তব্য, ‘পুলিশের লাঠি আর লাথি খেয়ে শরীরে এখনও যন্ত্রণা রয়েছে। কিন্তু এই মিছিলে আমাকে যোগ দিতেই হবে। তাই ফিরে এসেছি। আমরা আবার যত দ্রুত সম্ভব চক–ডাস্টারে ফিরে যেতেই চাই।’ আলিপুরদুয়ার থেকে এসেছিলেন সংস্কৃতের শিক্ষিকা প্রতিমা রায়। বাড়িতে দেখার কেউ নেই বলে আড়াই বছরের ছেলেকে কোলে নিয়েই তিনি মিছিলে সামিল হন। প্রতিমা বলেন, ‘আমরা বুধবার আলিপুরদুয়ারের ডিআই অফিসেও অভিযান করেছি।’ মুখ্যমন্ত্রী স্কুলে যোগ দিতে বললেও তাঁরা কেন বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন? প্রতিমার উত্তর, ‘মুখ্যমন্ত্রী আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমের কথা বলেছেন। আমরা কেন স্বেচ্ছাশ্রমে যাব? আমরা যে বেআইনি ভাবে নিযুক্ত হয়েছি, সেটা আগে প্রমাণ করুন।’ ঘটনাচক্রে প্রতিমার স্বামী কলকাতা পুলিশে চাকরি করেন। প্রতিমা জানান, তাঁর স্বামী এই আন্দোলনের পাশেই আছেন।
আরজি করের ঘটনার পরে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠা প্রতিবাদী চিকিৎসক দেবাশিস হালদারও মিছিল যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘শুধু চিকিৎসকদের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, সাধারণ মানুষ হিসেবেই মিছিলে এসেছি। যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে গেল ও যোগ্য শিক্ষকরা বঞ্চিত হলেন, তারই প্রতিবাদে মিছিল এসেছি।’ লাঠি হাতে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত পুরোটাই হেঁটেছেন। তিনি বলেন, ‘একটা প্রতিবাদ দরকার। আমার ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমেছে। আমি কি বাড়িতে বসে থাকব? প্রয়োজন হলে হামাগুড়ি দিয়েই আসব। এই অবিচার সহ্য করে বাড়িতে বসে থাকা যায় না।’
মিছিলে বার বার ২০১৬–র পরীক্ষার ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ প্রকাশের দাবি ওঠে। সঙ্গে দ্রুত যোগ্যদের তালিকা প্রকাশের দাবি। আরজি করার ধাঁচে মিছিলে স্লোগান ওঠে—‘উই ওয়ান্ট মিরর ইমেজ’। সেই সঙ্গে ‘কলকাতা পুলিশ হায় হায়’, ‘এসএসসি মুর্দাবাদ’, ‘মুখ্যমন্ত্রী–শিক্ষামন্ত্রী ধিক্কার’–এর মতো স্লোগানও উঠেছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কসবার ঘটনার প্রতিবাদে কালো ব্যাজ পড়েছিলেন। পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে, এমন দাবিও তোলেন তাঁরা। ডোরিনা ক্রসিংয়ে মিছিল পৌঁছতেই কয়েক হাজার শিক্ষক–শিক্ষিকা রাস্তায় বসে পড়েন। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ধর্মতলা।