• জাল-ভেজালে দিব্যি ব্যবসা চালাচ্ছে মগনলালরা
    এই সময় | ১১ এপ্রিল ২০২৫
  • নট অফ স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি (এনএসকিউ)। অ্যাডাল্টারেটেড। স্পুরিয়াস। আর মিসব্র্যান্ডেড।

    ড্রাগ স্টেস্টে ফেল করা ওষুধে গন্ডগোলের মূলত এই চারটি ধরন হয়। এর মধ্যে ড্রাগ কন্ট্রোলের মাথাব্যথার কারণ হলো অ্যাডাল্টারেটেড বা ভেজাল ওষুধ এবং স্পুরিয়াস বা জাল ওষুধ। আমতায় ধরা পড়েছিল এই দু’টি গোত্রের ওষুধই। তার পরেই বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় ধরপাকড় শুরু হয়েছে এই সব ওষুধের কারবারিদের। আমতা আর হরিয়ানার সোনপথে গ্রেপ্তারিও হয়েছে।

    এনএসকিউ হলো সেই ওষুধ যাতে ওষুধের মূল উপাদান বা অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট থাকে পরিমাণে বা গুণমানে অপর্যাপ্ত। অথবা সেই উপকরণ শনাক্তকরণে সমস্যা হয় ল্যাবে অথবা জলে তার দ্রাব্যতা সন্তোষজনক নয়। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের প্রাক্তন কর্তা তথা ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুভাষচন্দ্র মণ্ডলের কথায়, ‘এনএসকিই ওষুধ নিয়ে চিন্তা কম। কারণ এই সব ওষুধ সার্বিক ভাবে নয়, আসল কোম্পানির আসল ওষুধের বড়জোর একটি বা দু’টি ব্যাচে উৎপাদনে ত্রুটি থাকে যা পরে শুধরেও নেয় উৎপাদক সংস্থা।’ তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও) প্রতি মাসে যে এনএসকিউ তালিকা বের করে, সেখানে এমনই ওষুধের নাম থাকে।

    আসল চিন্তা হলো পরবর্তী তিন ধরনের ওষুধ নিয়ে। এর মধ্যে মিসব্র্যান্ডেড ওষুধে অসাধু ব্যবসায়ীরা হয় নিজেরা একটা ওষুধ বানিয়ে তার প্যাকেজিংয়ে প্রচলিত বড় কোম্পানির বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নাম ছেপে দেয় অথবা সেই ওষুধের ব্যবহার অন্য বলে প্রচার করে বিক্রির জন্য। অনেকটা, গ্যাস-অম্বলের ওষুধ বানিয়ে তাকে জ্বরের ওষুধ বলে বাজারে বিক্রি করার মতো। ওষুধ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, সবচেয়ে ব়ড় চিন্তা হলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজাতি, অর্থাৎ ভেজাল ও জাল ওষুধ নিয়ে। ভেজাল ওষুধে ইচ্ছাকৃত ভাবে অনভিপ্রেত যৌগ মিশিয়ে দেওয়া হয় উপাদানে। আর জাল ওষুধে অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট বা মূল উপাদানটাই থাকে না। আসল কোম্পানি আসল ওষুধ বাজারজাত করার পরেই সেগুলির প্যাকেজিংয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি ‘কপি’ করে জাল ও ভেজাল ওষুধ বাজারে ছেড়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা।

    ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এই দু’রকমের ওষুধই আছে। এবং দীর্ঘদিন ধরেই আছে। তার প্রমাণ মেলে সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ উপন্যাসে, যা ১৯৮০ সালে প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। অনীকেন্দ্র সোমের বন্ধু হিমাদ্রি চক্রবর্তী ভেজাল ওষুধে মারা পড়ার পরে তাঁর ‘ডিসপেন্সিং’ চিকিৎসক দিবাকর মানতে পারেননি তাঁর দেওয়া ওষুধ জাল হতে পারে! তাঁর দাবি ছিল, তিনি ওষুধ কেনেন ব্যাচ নম্বর, এক্সপায়ারি ডেট দেখেই। তাঁকে অবশ্য পাল্টা প্রদোষ মিত্র বলেছিলেন, ‘সে সব কি জাল করা যায় না?’

    ডাক্তার দিবাকর আর ফেলুদার সেই কাল্পনিক কথোপকথন আজকের ঘোর বাস্তব। ফেলুদার তদন্তে ধরা পড়েছিল মগনলাল মেঘরাজ। আর আজ ৪৫ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে বাস্তবের ‘মগনলাল’রা রয়েছে বহাল তবিয়তেই। তাদের ব্যবসাই হলো এই অ্যাডাল্টারেটেড আর স্পুরিয়াস ওষুধ নিয়ে। ওষুধ ব্যবসায়ীরাই জানাচ্ছেন, করোনা–পর্বের পর থেকে গত পাঁচ বছরে জাল ওষুধের কারবারিদের এ দেশে প্রায় ৪০০% ব্যবসা বেড়েছে। ক্রমাগত সেই ফুলে-ফেঁপে ওঠা কারবারে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের পেটের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত প্রাণদায়ী ওষুধের বদলে আজও ভরে দেওয়া হয় চকের গুঁড়ো আর স্টার্চ।

    ঠিক যেমনটা উল্লেখ ছিল তোপসের বয়ানে। নিমেষে নকল হচ্ছে আসল ওষুধের প্যাকেজিংয়ে থাকা ব্যাচ নম্বর, এক্সপায়ারি ডেট। এমনকী, কিউআর কোডও (ফেলুদার উপন্যাসের সময় যা ছিল না অবশ্য)। প্রায় পাঁচ দশক আগে কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠে যেমন মিলত জাল ওষুধ, আজও তা তেমনই মিলছে ফুলবাগান, ক্যানিং স্ট্রিট, আমতার মতো খাস কলকাতা বা শহরতলির বিভিন্ন জায়গায়।

    কিছু দিন আগেই কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিডিএসসিও জানিয়েছে, দেশের অগ্রগণ্য ও ব্যাপক জনপ্রিয় একটি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের জাল (স্পুরিয়াস) ব্র্যান্ড মিলেছে বাংলা থেকে। ওষুধে ‘টেলমিসার্টান’ ও ‘অ্যাম্লোডিপিন’ নামের যে দু’টি রক্তচাপ কমানোর ওষুধের কম্বিনেশন থাকার কথা ছিল, ট্যাবলেটগুলির ড্রাগ ল্যাবে টেস্টে তার ছিটেফোঁটাও মেলেনি। উল্টে মিলেছে ক্যালসিয়াম ফসফেট। সহজ বাংলায়, চকের গুঁড়ো। সঙ্গে ছিল স্টার্চ, ট্যালকম-সহ আরও কিছু উপাদান, যেগুলি পেটে গেলে কোনও ক্ষতি নেই। তবে এতে কমবে না রক্তচাপ। ফলে বিপদ অনিবার্য।

    এ তো গেল একটি ওষুধের কথা। কিন্তু সিডিএসসিও যে গুণমান অনুত্তীর্ণ ওষুধের তালিকা প্রতি মাসে প্রকাশ করে, তাতে নিয়মিত দেখা মেলে এই ভেজাল (অ্যাডাল্টারেটেড) এবং জাল (স্পুরিয়াস) ওষুধ। তাতে জ্বর ও ব্যথা কমানো থেকে শুরু করে প্রেশার-সুগার-কোলেস্টেরলের ওষুধ, এমনকী অ্যান্টিবায়োটিকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডও থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধ কাঙ্ক্ষিত কাজ না–করলে তো প্রাণ সংশয়ের উপক্রম! ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাম্ব সম্রাট সমাজদার বলেন, ‘কারও যদি জাল কিংবা ভেজাল ওষুধ খেয়ে রক্তচাপ না কমে, তা হলে তো তাঁর স্ট্রোকও হতে পারে। কিংবা জাল বা ভেজাল অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসা মানে তো পরিস্থিতি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।’

  • Link to this news (এই সময়)