ওএমআরের তথ্য নষ্ট করলেন কারা? কাদের হাতে অযোগ্যদের নিয়োগ? সিবিআই চার্জশিটে এসএসসি দুর্নীতির ‘চারমূর্তি’
আনন্দবাজার | ১১ এপ্রিল ২০২৫
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাংলার প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। ২০২২ সাল থেকে এই সংক্রান্ত তদন্ত করছে সিবিআই। আদালতে তারা একাধিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেক ‘প্রভাবশালী’ নাম এসেছে সেই সমস্ত চার্জশিটে (যার প্রতিলিপি আনন্দবাজার ডট কমের কাছে রয়েছে)। চার্জশিটে এসএসসি-র তিন উচ্চপদস্থ কর্তা এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক কর্তার নাম বার বার উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাঁরাই এসএসসি দুর্নীতিতে সিবিআইয়ের ‘চারমূর্তি’।
দুর্নীতির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে ‘চারমূর্তি’র প্রত্যক্ষ যোগ ছিল বলে অভিযোগ। ওএমআর শিটের তথ্য নষ্ট থেকে শুরু করে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ, নম্বরে কারচুপি — এসএসসি মামলায় শুরু থেকেই এই চার জনের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের অভিযোগ ভূরি ভূরি। আপাতত তাঁরা প্রত্যেকে জেলে। অনেকের মতে, চাকরি বাতিল এবং সেই সংক্রান্ত যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার মূলে এই চার জন। কারণ, এসএসসি মামলায় একটা বড় অংশে যোগ্য এবং অযোগ্য চাকুরিরতদের আলাদা করা যায়নি। অভিযোগ, উত্তরপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করেছে আদালত। উত্তরপত্রের তথ্য নষ্টের অভিযোগ রয়েছে মূলত এই ‘চারমূর্তি’র বিরুদ্ধেই।
শান্তিপ্রসাদ সিন্হা
- নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসএসসি-র পরামর্শদাতা পদে ছিলেন শান্তিপ্রসাদ সিন্হা। নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ২০২২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
- অযোগ্য প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ এবং তাঁদের থেকে টাকা তোলার জন্য নিয়োগ করেছিলেন প্রসন্ন রায়, রোহিত কুমার ঝার মতো ‘মিড্লম্যান’ বা মধ্যস্থতাকারীদের।
- নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য প্রার্থীদের জন্য জাল সুপারিশপত্র তৈরি করিয়েছিলেন। তাঁর হয়ে তাঁর নির্দেশে এই কাজ করেছিলেন কমিশনের আধিকারিক সমরজিৎ আচার্য।
- প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও ১৮৩ জনের জাল সুপারিশপত্র প্রকাশ করেছিল কমিশন। ওই প্রার্থীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন শান্তিপ্রসাদ। সেই কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ও।
- ভুয়ো নিয়োগপত্র তৈরি করে তার ভিত্তিতে এই অযোগ্য প্রার্থীদের রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হয়েছিল।
উত্তরপত্র বা ওএমআর শিটের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নষ্ট করে দিয়েছেন শান্তিপ্রসাদ। তার মধ্যে ছিল ওএমআরের ‘ব্যাকআপ’ এবং স্ক্যান করা প্রতিলিপি (সফ্ট কপি)। সিবিআই জানিয়েছে, ওই সমস্ত তথ্য যাতে নষ্ট হয়, তা নিশ্চিত করেছিলেন শান্তিপ্রসাদ স্বয়ং।
- দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং চাকরির দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই পথে ‘বঞ্চিত’ চাকরিপ্রার্থীরা। সিবিআইয়ের চার্জশিট অনুযায়ী, ওই ধরনের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থেকে চার জনকে আলাদা করে বেআইনি ভাবে চাকরি দিয়েছিলেন খোদ মন্ত্রী পার্থ। সেই কাজেও তাঁকে সহায়তা করেছিলেন শান্তিপ্রসাদ।
- পার্থের ওএসডি প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শান্তিপ্রসাদের হোয়াট্সঅ্যাপ কথোপকথন সিবিআই হাতে পেয়েছে। সেখান থেকেই বিক্ষোভরত প্রার্থীদের বেআইনি নিয়োগের কথা জানা গিয়েছে।
সুবীরেশ ভট্টাচার্য
এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন সুবীরেশ ভট্টাচার্য। তাঁর বিরুদ্ধেও বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ এনেছে সিবিআই। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা।
- চার্জশিটে অভিযোগ, কমিশনের সার্ভারে ওএমআর শিটের নম্বর বদলে দিয়েছিলেন সুবীরেশ। ওই সময়ে কমিশনের চুক্তিভিত্তিক কর্মী ছিলেন পর্ণা বোস। সুবীরেশের নির্দেশে নম্বর বদলানোর কাজটি করেছিলেন পর্ণা।
- সিবিআই চার্জশিটে জানিয়েছে, ওএমআর মূল্যায়নকারী সংস্থা ‘নাইসা’র কাছ থেকে নম্বর আসার পরে অযোগ্য প্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পর্ণাকে মৌখিক নির্দেশ দিতেন সুবীরেশ। তার পরে ওই বর্ধিত নম্বর অনুযায়ী প্রার্থীদের ‘পার্সোনালিটি টেস্ট’ বা ব্যক্তিত্বের পরীক্ষা নেওয়া হত।
- নম্বর বদলানোর জন্য ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদেরও প্রভাবিত করতেন সুবীরেশ। একাধিক চাকরিপ্রার্থীর শারীরশিক্ষার (পিটি) প্রাপ্ত নম্বরে কারচুপি করা হয়েছিল। আঞ্চলিক চেয়ারপার্সনদের সুবীরেশ নির্দেশ দিতেন, ওই সংক্রান্ত নম্বরের খাতা ফাঁকা রাখতে বা তাতে পেনসিলে নম্বর লিখতে। যাতে পরে তা সহজেই পরিবর্তন করা যায়। অযোগ্য প্রার্থীদের প্যানেলে ঢোকানোর জন্য ওই কাজ করেছিলেন সুবীরেশ।
- ওএমআর শিটের তথ্য নষ্ট করার অভিযোগও রয়েছে সুবীরেশের বিরুদ্ধে। শান্তিপ্রসাদের মতো তিনিও উত্তরপত্রের ‘ব্যাকআপ’ এবং সফ্ট কপি নষ্টের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন।
অশোক সাহা
- এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদে সুবীরেশের মতো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব সামলেছেন অশোকও। তাঁর আমলেও দুর্নীতি হয়েছে বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে সুবীরেশের সঙ্গেই অশোককেও গ্রেফতার করা হয়।
- চার্জশিটে কেন্দ্রীয় সংস্থা জানিয়েছে, নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অশোক ১৮৩টি জাল সুপারিশপত্র এবং নিয়োগপত্রে অনুমতি দিয়েছিলেন। এর ফলে প্যানেল-বহির্ভূত অযোগ্য প্রার্থীরা বিভিন্ন স্কুলে চাকরি পেয়েছেন।
- ওএমআর সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নষ্ট করার ক্ষেত্রেও অশোকের ভূমিকা ছিল। শান্তিপ্রসাদ এবং সুবীরেশের মতো উত্তরপত্রের ‘ব্যাকআপ’ এবং সফ্ট কপি নষ্ট করেছিলেন তিনিও।
- চাকরির দাবিতে বিক্ষোভরত চার প্রার্থীকে বেআইনি নিয়োগের জন্য শান্তিপ্রসাদ এবং পার্থকে সাহায্য করেছিলেন অশোক।
কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়
- এসএসসি-র সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনিও অযোগ্যদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁকেও সিবিআই গ্রেফতার করে ২০২২ সালে।
- সিবিআই জানিয়েছে, অযোগ্যদের চাকরি দেওয়ার জন্য শান্তিপ্রসাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিলেন কল্যাণময়। ১৮৩ জন অযোগ্য প্রার্থীকে ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়েছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলে তাঁরা চাকরি পেয়েছেন।
- অযোগ্য প্রার্থীদের নামে যে সুপারিশপত্রগুলি দেওয়া হয়েছিল, ৯০ দিনের মাথায় তার ভিত্তিতে প্রত্যেকের কাছে নিয়োগপত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কল্যাণময় নিজে।
আরও কারা চার্জশিটে
এই ‘চারমূর্তি’ ছাড়াও চার্জশিটে পর্ণা বোস, প্রসন্ন রায়দের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি ব্যাখ্যা করেছে সিবিআই। উল্লেখ করা হয়েছে প্রসন্নের অধীনে কর্মরত প্রদীপ সিংহ, অযোগ্য প্রার্থী জুঁই দাস, মহম্মদ আজ়াদ আলি মির্জ়া এবং ইমাম মোমিনদের নাম।
- কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা জানিয়েছে, পর্ণা প্রোগ্রাম অফিসার হিসাবে এসএসসি-তে কাজ করতেন। অযোগ্য প্রার্থীদের নম্বরে যাবতীয় কারচুপি যে সার্ভারে হয়েছে, তার দায়িত্বে ছিলেন পর্ণা।
- এসএসসি দুর্নীতির প্রধান ‘মিড্লম্যান’ ছিলেন প্রসন্ন। গোটা রাজ্যে বহু এজেন্টের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। অযোগ্য প্রার্থীদের তথ্য জোগাড় করেছিলেন এবং তাঁদের থেকে টাকাও তুলেছিলেন প্রসন্ন। নিয়োগের জন্য তাঁদের শান্তিপ্রসাদের কাছে সুপারিশও করেছিলেন। প্রসন্নর নির্দেশে একই কাজ করেছিলেন তাঁর কর্মচারী প্রদীপ।
- জুঁই, আজাদ আলি, মোমিনরাও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মিড্লম্যান এবং এজেন্টদের কাছ থেকে জাল নিয়োগপত্র সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা। তার ভিত্তিতে নিয়োগও হয়েছিল। জুঁই ও আজাদ আলি বাংলার শিক্ষক হিসাবে এবং মোমিন ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে চাকরি পেয়েছিলেন।