নিজেকে ‘চাষার ব্যাটা’ বলতে ভালবাসতেন বরাবর। শরীর ভেঙে পড়লেও কাঁধে গামছা ফেলে তাঁর সেই বেপরোয়া, একরোখা, ঠোঁটকাটা ভাবমূর্তি এখনও মানুষের মনে টাটকা। সেই ‘চাষার ব্যাটা’ আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা প্রয়াত হলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা শুক্রবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে রেজ্জাকের বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের বাঁকড়ি গ্রামে নিজের বাড়িতেই মৃত্যু হয় তাঁর। ‘চাষার ব্যাটা’র মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ রাজনৈতিক মহল। পরিবার সূত্রে খবর, শেষ ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে ওই বাড়িতেই সম্ভবত সমাধিস্থ করা হবে রেজ্জাক মোল্লাকে।
দীর্ঘ দিন ধরে তিনি কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। এছাড়া চোখে সমস্যা ছিল। হৃদরোগও ছিল। নিউটাউনে ফ্ল্যাট থাকলেও ভাঙড়ে দেশের বাড়িতেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার দিন সিঙ্গুর প্রসঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে কটাক্ষ করে ‘চাষার ব্যাটা’ বলেছিলেন রেজ্জাক। সেদিন তিনি বামেদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘হেলে ধরতে পারে না, গিয়েছে কেউটে ধরতে।’ একুশ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আগেও তিনি বলেছিলেন, মমতাই ফের সরকার গড়বে।
ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি ভাঙড়ের বাঁকড়ি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান রেজ্জাকের। তৎকালীন সিপিএমের জেলা নেতা শিবদাস ভট্টাচার্যের হাত ধরে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ। রাজনৈতিক জীবনে ১৯৭২ সালে প্রথম ভাঙড় থেকে লড়ে বিধায়ক হন তিনি। সেবার ভোটে হারেন স্বয়ং জ্যোতি বসু। ১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় ক্যানিং পূর্ব থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮২ থেকে ২০০৬ টানা ছ’বার মন্ত্রী হন রেজ্জাক। বাম আমলে মন্ত্রী হিসাবে ভূমি সংস্কার, সুন্দরবন উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব সামলেছেন দীর্ঘদিন।
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের ভোটে হেরে যান তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু, সেবারও হারেননি রেজ্জাক। বাম আমলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিলেন রেজ্জাক। গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগণা চলত কার্যত তাঁর কথায়। সোজাসাপটা কথা বলতে বরাবরই পছন্দ করতেন। তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বকে অনেক সময়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। ২০১৪ সালে সিপিএমের রাজ্য কমিটি রেজ্জাক মোল্লাকে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে বহিষ্কার করে।
এরপর ভারতীয় ন্যায়বিচার পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন তিনি। দু’বছর পর সেখান থেকেও বহিষ্কৃত হতে হয় তাঁকে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় রেজ্জাকের। ২০১৬ সালে তিনি তৃণমূলে কংগ্রেসে যোগ দেন। সেই বছরই ভাঙড় থেকে তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হন। গোষ্ঠীকোন্দলকে হারিয়ে ভাঙড়ে ঘাসফুল ফোটান ‘চাষার ব্যাটা’। খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী করা হয় তাঁকে। ২০২১ সালে বয়সজনিত কারণে রেজ্জাককে আর টিকিট দেয়নি তৃণমূল।
রেজ্জাক মোল্লার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স হ্যান্ডলে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমার সহকর্মী, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা’র প্রয়াণে আমি শোকাহত ও মর্মাহত। তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভায় আমার সহকর্মী ছিলেন। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, সম্মান করতাম। বাংলার গ্রামজীবন, কৃষি-অর্থনীতি ও ভূমি-সংস্কার বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল সুবিদিত। তাই একসময় অন্য ধারার রাজনীতি করলেও, মা-মাটি-মানুষের সরকারে তাঁর মিলিত হয়ে যাওয়া ছিল সহজ ও স্বাভাবিক। তাঁর প্রয়াণে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হল। আমি তাঁর পরিবারবর্গ, অসংখ্য অনুগামী ও শুভানুধ্যায়ীকে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’