• আনাড়ায় কাশির হংসেশ্বরানন্দ যেন ‘রাজা গোবিন্দমাণিক্য’, জলে কাল ভৈরবনাথ মন্দিরের হাঁড়িকাঠ, বন্ধ প্রাচীন বলিপ্রথা
    বর্তমান | ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • পিনাকী ধোলে, পুরুলিয়া: রবি ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের প্রথম প্রকাশ ১৮৮৭ সালে। তারও প্রায় ৩৬২ বছর আগে থেকে পুরুলিয়ার আনাড়ার বাবা বাণেশ্বর ধামের কালভৈরবনাথ মন্দিরে বলিপ্রথা চলে আসছে। অর্থাৎ, ‘রাজর্ষি’ প্রকাশিত হওয়ার পরও বলিপ্রথা পার করে ফেলেছে প্রায় ১৩৮ বছর। মন্দিরে পশুবলি নিয়ে হিংসা-অহিংসার দ্বন্দ্ব চলেছে অনবরত। কিন্তু এতদিন স্রেফ দেবতার রুষ্ট হওয়ার ভয়ে হিংসারই জয় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অহিংস প্রেমের পুজোর ভাবনাকেই জিতিয়ে দিলেন উত্তর কাশির হংসেশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ। অনেকটা ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দিলেন কালভৈরবনাথ মন্দিরের পাঁচশো বছরের বলিপ্রথা। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় বলিপ্রথাকে তুড়ি মেরে হারিয়ে নিজেই উপড়ে ফেললেন হাঁড়িকাঠ। শেষবারের মতো সেটিকে বিসর্জন দিলেন মন্দির সংলগ্ন শিবগঙ্গা সায়রে। সর্বতোভাবে সহযোগিতা করলেন মন্দির কমিটি থেকে শুরু করে সেবাইত ও পুরোহিত।    

    গোমতী নদীর পাড়ে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ঘাট। গ্রীষ্মের এক সকালে স্নান করতে গিয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হাসি ও তাতা নামে ভাইবোনের। সেই থেকে মহারাজের সঙ্গে তাদের বেশ ভাব। একদিন ঘাটে রক্ত দেখে হাসি গোবিন্দমাণিক্যের কাছে জানতে চাইল—‘মহারাজ, রক্তের দাগ কিসের?’ কোনও জবাব দিতে পারেননি মহারাজ। উত্তর না পেয়ে নিজের আঁচল দিয়ে রক্ত মুছতে থাকে হাসি। বাড়ি ফিরে প্রবল জ্বরে পড়ে সে। জ্বরের বিকারে মাঝে মাঝেই সে বলে ওঠে ‘রক্তের দাগ কিসের?’ সেই জ্বর থেকে আর সেরে উঠতে পারেনি হাসি। মৃত্যুর আগেও তার মুখে ছিল ওই একটাই প্রশ্ন। পুরো ঘটনায় গোবিন্দমাণিক্য খুব আঘাত পান। তারপরই তিনি নির্দেশ দেন, ভুবনেশ্বর মন্দিরে মহিষবলি প্রথা বন্ধ। বাধ সাধেন রাজার বড় ভাই ও মন্দিরের পুরোহিত রঘুপতি। ভাইয়ের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে রাজ্য ছাড়েন গোবিন্দমাণিক্য। তবে কয়েক বছর পর রঘুপতি বুঝতে পারেন, দেবতার সাধন-ভজনে প্রেমই সম্পদ। নরবলি কিংবা পশুবলির কোনও মূল্য নেই। একদিন নিজেই কালীর মূর্তি ছুড়ে ফেলে দেন নদীতে। বন্ধ করেদেন বলিও। কালভৈরবনাথ মন্দিরে বলিপ্রথা বন্ধের সঙ্গে রবি ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’র কাহিনিকে মিলিয়ে পশুপ্রেমীরা বলছেন, ‘অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ। জয় মানবতার জয়।’ 

    কালভৈরবনাথ মন্দিরে পশু বলির ইতিহাস পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। নীলপুজো এবং পয়লা বৈশাখের দিন মন্দিরে ছাগ বলি হয়। তবে, দীর্ঘদিন ধরেই বলিপ্রথা বন্ধের চেষ্টা করে আসছিলেন মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা চক্রবর্তী ও দেওঘড়িয়া ১৬ আনা কমিটির সদস্যরা। এনিয়ে বিতর্কও চলছিল। কয়েক দশক ধরে চলে আসা একটি প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউই। শেষে হংসেশ্বরানন্দ গিরি মহারাজের শরণ নেন সকলেই। তিনিই বৃহস্পতিবার পুজো অর্চনার পর হাঁড়িকাঠ উপরে ফেলেন। মহারাজ বলছিলেন, ‘বলি মানে মনের পশুত্বকে বলি দেওয়া। কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসাকে বলি দেওয়া উচিত। শিবপুরাণে বলি দেওয়ার কোনও আদেশ নেই। বলিপ্রথা ধর্মের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। ঈশ্বর বা দেবতা কখনই কারও প্রাণ বলিতে তুষ্ট হন না। বরং আত্মত্যাগ, শুদ্ধ চিন্তা ও মানবসেবাই হল ঈশ্বর সন্ধানের প্রকৃত পথ।’  

    মন্দিরের অন্যতম সেবাইত সজল দেওঘড়িয়া বলেন, ‘আমাদের আনাড়া গ্রামে দুর্গাপুজোতে বলি হতো। কিন্তু ২০১৯ সালে আমরা বলি বন্ধ করি। তারপর থেকে কালভৈরবনাথ মন্দিরেও বলি বন্ধ করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ দশক ধরে চলে আসা একটা নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো সাহস ছিল না আমাদের।’ মন্দিরের সেবাইত বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘কাশি থেকে আগত স্বামী হংসেশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ আমাদের সাহস যোগান। পাপ পুণ্যের ভাগ নিজের কাঁধে নিয়ে হাঁড়িকাঠ উপরে ফেলেন মন্দির থেকে।’
  • Link to this news (বর্তমান)