• ৯০০০ কোটি টাকার জাল ওষুধ বাজারে
    এই সময় | ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • আপাত ভাবে এঁদের সকলে অসাধু ব্যবসায়ী নন। কিন্তু অধিকাংশই লোভী, যাঁরা স্রেফ বেশি মুনাফার আশায় ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে চলেছেন। আর এই অতি লোভের কারণে তাঁরা অজান্তেই নিছক অংশ হয়ে পড়ছেন না জাল ওষুধ চক্রের কারবারে, অনেকাংশে ইন্ধনও জোগাচ্ছেন এই চক্রকে।

    ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে খবর, সাধারণ ওষুধের দোকানিরা (রিটেল কেমিস্ট) ওষুধ কেনেন পাইকারি বাজারের দ্বিতীয় স্তর (স্টকিস্ট বা ডিস্ট্রিবিউটর) থেকে। স্টকিস্টরা আবার ওষুধ কেনেন পাইকারি বাজারের প্রথম স্তর ক্যারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সি অ্যান্ড এফ) এজেন্টদের থেকে। এবং সি অ্যান্ড এফ-রা ওষুধ কেনেন সরাসরি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার থেকে। কিন্তু অতি লোভী কেমিস্ট ও স্টকিস্ট-রা পরিচিত এই চেনের বাইরে গিয়ে কম দামে ওষুধ কেনেন। এবং প্রায়ই তাঁরা অজান্তেই জড়িয়ে পড়েন জাল ও ভেজাল ওষুধের নেটওয়ার্কে।

    তাঁদের বোঝানো হয়, এই ওষুধ আসছে আসল কোম্পানির প্লান্ট থেকে ‘পিছনের দরজা’ দিয়ে। অর্থাৎ কিনা, ওষুধ আসল, শুধু কোম্পানি কর ফাঁকি দিতে চায় বলে ‘ব্যাক ডোর’ দিয়ে কম দামে ওষুধ বেচে দিচ্ছে! জাল ওষুধের চক্রীরা নিজেকে ওই কোম্পানির প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ভিন রাজ্য থেকে ফোনে যোগাযোগ করেন এখানকার ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েই জাল ওষুধ ব্যবসার অংশ হয়ে উঠছেন বঙ্গের ওষুধ বিক্রেতারা। তাঁরা বুঝতেও পারেন না, এগুলো নকল বা জাল ওষুধ। কারণ দেখে চেনার উপায় নেই, এতটাই নিখুঁত নকল।

    চিনবেনই বা কী করে! নকল ওষুধ মোড়া থাকে যে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কিংবা ব্লিস্টার স্ট্রিপে, সেগুলি তো দেখতে হুবহু আসলের মতো। বাক্সও তাই। বলাই বাহুল্য, আসল ওষুধ বাজারজাত করার সময়ে যে ব্যাচ নম্বর ও এক্সাপায়ারি ডেট উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, জাল কিংবা ভেজাল ওষুধের কারবারিরাও সেটাও ‘কপি’ করে ষোলো আনা। এমনকী, ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে হুবহু তারা নকল করে ফেলে আসল কোম্পানির দেওয়া কিউআর কোডও। অথচ কুচক্রীরা যাতে ওষুধ জাল করতে না পারে, তার জন্যই ২০২২ সালে দেশের প্রায় ৫১ হাজার ব্র্যান্ডের মধ্যে থেকে বাছাই করা ৩৪৮টি ‘ফাস্ট মুভিং’ ব্র্যান্ডে কিউআর কোড বাধ্যতামূলক করেছিল কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

    কিন্তু তাতে লাভ হলো কই! সেই কোডও নিমেষে ব্যাচ ধরে ধরে জাল করে ফেলছে জাল ওষুধের কারবারিরা। তদন্ত নেমে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর ধৃতদের জেরা করে ড্রাগ কন্ট্রোলের অফিসাররা জানতে পেরেছেন, উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় আসল ওষুধের বাক্সে ও স্ট্রিপে থাকা কিউআর কোডের লিঙ্ক কপি করে নেয় ওই চক্রীরা প্রথমে। তার পর ওয়েব-বেসড কিউআর কোড জেনারেটরের সাহায্যে একই কিউআর কোড বানিয়ে নিয়ে সেগুলো ছেপে দেওয়া হয় জাল ওষুধের বাক্সে ও স্ট্রিপে। ফলে কেউ সেই কোড স্মার্টফোনে স্ক্যান করলে, আসল কোম্পানি থেকেই ওই ওষুধ সম্পর্কে যথাযথ সঠিক তথ্যই পেয়ে যান। এত কিছু পর আর কে-ই বা সন্দেহ করবে!

    এত দূর তদন্তকারীরা জানতে পারলেও, এখনও সরকারের কাছে নির্দিষ্ট ভাবে কোনও তথ্য নেই, এমন কত ঘটনা নিত্য ঘটছে। কারণ, ভেজাল ওষুধের বহরটা ঠিক কত বড়, তা নিয়ে সঠিক ধারণা নেই কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকার, কারও। পাইকারি ও খুচরো ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেঙ্গল কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিসিডিএ)-এর মুখপাত্র শঙ্খ রায়চৌধুরী বলেন, ‘শতকরা হিসেবে হয়তো আসল ওষুধের তুলনায় জাল বা ভেজাল ওষুধের পরিমাণটা নগণ্য। কিন্তু আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যায় এত বড় ওষুধ শিল্পে সেই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। কত মানুষের যে ক্ষতি হচ্ছে, ইয়ত্তা নেই।’

    সর্বভারতীয় একাধিক ওষুধ বিক্রেতাদের হিসেব বলছে, এ দেশে ওষুধ শিল্পের বাজার প্রায় ২.২০ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যেই প্রায় ৪% হলো জাল ওষুধের বাজার। অর্থাৎ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। অতিমারীর আগে যে বাজার ছিল ১% বা তারও কম। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের আগ্রা, গাজ়িয়াবাদ আর মেরঠ এবং লাগোয়া হরিয়ানার সোনপথ থেকে যে জাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে, তার বহর গত তিন-চার বছরে বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিহার, ঝাড়খণ্ড আর ওডিশা হয়ে সড়কপথে সেই জাল ওষুধ উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, পশ্চিম বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুর হয়ে কলকাতা ঘুরে যে ঢুকছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, আমতায় জাল ওষুধের চক্র ধরা পড়ার পর, ধৃত বাবলু মান্নাকে জেরা করে সে ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিত ড্রাগ কন্ট্রোলের তদন্তকারী ইনস্পেক্টররা।

  • Link to this news (এই সময়)