• মাইনে কী ভাবে? ধন্দ প্রধান শিক্ষক, ডিআই, মন্ত্রীরও
    এই সময় | ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গত সোমবার তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষকদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘যান না কাজে (স্কুলে), কে যেতে বারণ করেছে? ভলান্টারি সার্ভিস সবাই দিতে পারে।’

    কিন্তু স্কুলে গিয়ে ‘সার্ভিস’ দিলে কি বেতন মিলবে? মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের চার দিন বাদেও এই প্রশ্নের উত্তর অধরা চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের কাছে। গত বুধবার স্যালারি পোর্টাল চালু হলেও শুক্রবারও জেলায় জেলায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা বুঝে উঠতে পারছেন না, ‘যোগ্য’ ও ‘অযোগ্য’ নির্বিশেষে সবার নাম এ মাসের বেতনের জন্য পাঠানো হবে কি না।

    আবার জেলা স্কুল পরিদর্শক বা ডিআই–রাও অন্ধকারে। তাঁরা আপাতত প্রধান শিক্ষকদের ক’টা দিন অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেটাও আবার মৌখিক ভাবেই! আর রাজ্য সরকার? তাদের বক্তব্য, এ নিয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। তবে সূত্রের দাবি, সবাই আপাতত অপেক্ষা করছেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তরফে সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন করা হয়েছে, তার শুনানির দিকে।

    এসএসসি–র ২০১৬–এর বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে হওয়া প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ বাতিল হওয়ার পরে গত সোমবারই পর্ষদ একটি আবেদন করেছে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে। আগামী ১৭ এপ্রিল সেই আবেদনের শুনানি হতে পারে বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। সেই শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট কী নির্দেশ দেয়, আপাতত তার জন্যই অপেক্ষা করছে সব পক্ষ।

    নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার পরেও ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের অনেকেই বলেছিলেন, ‘আমরা সিভিক টিচার হতে চাই না।’ তাঁরা চান, যে ভাবে এতদিন তাঁরা চাকরি করছিলেন, সে ভাবেই কাজ করে যেতে চান এবং আগের মতোই তাঁদের বেতন বজায় থাকুক। যদিও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বৃহস্পতিবার বলেন, ‘চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা চলতি মাসের বেতন পাবেন কি না, সেটা আইনি পরামর্শ নিয়েই জানাব।’

    শুক্রবার চাকরিহারাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পরেও বেতন নিয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে পারেননি মন্ত্রী। এ দিনও আইনি পরামর্শ নেওয়ার কথাই শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পরে বুধবারই স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের স্যালারি পোর্টাল রাজ্যজুড়ে খুলেছে। ওই পোর্টালে চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের নাম থাকায় তাঁদের মধ্যে খানিক আশার সঞ্চার হয়েছিল। তবে তাঁদের নাম আদৌ এ মাসের স্যালারির জন্য পাঠানো হবে কি না, তা নিয়ে প্রবল ধন্দে রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা। তাঁরা দায় ঠেলছেন ডিআই–দের দিকে।

    প্রধান শিক্ষকদের অনেকে চিঠি দিয়েই জানতে চাইছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁদের করণীয় কী! আবার ডিআই–রা তাঁদের মৌখিক ভাবে বলছেন, ‘আমরাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষর নির্দেশিকার অপেক্ষা করছি। আপনারাও কিছুদিন ওয়েট করুন।’ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নাম–সহ স্যালারি পোর্টাল (i-osms) চালু হলেও চাকরিহারাদের জন্য বেতনের রিক্যুইজি়শন পাঠানো আইনসম্মত কি না, তা নিয়ে সব পক্ষই সংশয়ে। পর্ষদের মামলায় নতুন করে নিয়োগ না-হওয়া অথবা চলতি শিক্ষাবর্ষের শেষ পর্যন্ত চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার আবেদন করা হয়েছে স্কুলগুলির পরিকাঠামোর কথা মাথায় রেখে। শিক্ষাকর্তারা মনে করছেন, সেই আবেদনে শীর্ষ আদালত সাড়া দিলে এই চাকরিহারাদের নাম বেতনের জন্য পাঠাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সুপ্রিম কোর্ট আর্জি খারিজ করলে অথবা কোনও স্পষ্ট নির্দেশ না-দিলে কী হবে, প্রশ্নটা সেখানেই!

    এই অবস্থায় দোলাচলে থাকা পূর্ব মেদিনীপুরের বটতলা আনন্দময়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ঋষিকেশ দাস ডিআই’কে চিঠি লিখে বলেছেন, ‘আমাদের স্কুলে চাকরিহারা তিনজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষাকর্মী আছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁদের চাকরি গিয়েছে। অথচ স্যালারি পোর্টালে তাঁদের নাম রয়েছে। এখনও পর্যন্ত আমি এই চারজনের নামে স্যালারি রিক্যুইজি়শন জমা দিইনি।

    আপনি আমাকে নির্দেশ দিন, এঁদের বিষয়ে কী করব। আমি কি তাঁদের স্যালারি বিল জমা দেবো? নাকি আপনার তরফে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকব!’ ঝাড়গ্রামের জিতুশোল বিকাশ ভারতী শিক্ষায়তন হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মণীন্দ্রনাথ মাহাতোর কথায়, ‘বেতনের রিক্যুইজি়শন পাঠানোয় অনেক জটিলতা রয়েছে। ডিআই অফিস থেকে আমাদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেতন পোর্টালে কোনও শিক্ষকের নাম বাদ দেওয়ার বা যুক্ত করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। বেতন পোর্টালে প্রধান শিক্ষক ও স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি স্বাক্ষর–সহ অনলাইনে আপলোড ও ডিআই অফিসে পাঠাতে হয়। আমরা জোর করে কিছু করলে আদালত অবমাননার ভয় রয়েছে।

    অন্যদিকে, সময়ের মধ্যে বেতনের রিক্যুইজ়িশন না-পাঠানো হলে, স্কুলের অন্য শিক্ষক ও কর্মীদেরও এপ্রিলের বেতন হবে না।’ শিলিগুড়ির নেতাজি বয়েজ় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজীব ঘোষের কথায়, ‘সাধারণত, প্রতি মাসের ১০ তারিখে শিক্ষক ও কর্মীদের বেতনের তালিকা জমা দিতে হয়। এ মাসের পরিস্থিতি অন্যরকম। কোনও রকম সরকারি নির্দেশ আসেনি। যেমন নির্দেশ পাব, সেভাবেই কাজ করব।’

    ঝাড়গ্রামের বিরিহান্ডি বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয়কুমার মণ্ডল, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোলের নরসমুদা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক মুখোপাধ্যায় ও পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর-১ ব্লকের নিগমনগর নিগমানন্দ সেবাশ্রম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তীরও বক্তব্য একইরকম। তাঁরাও ডিআই-দের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।

    পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) মহুয়া বসাক বলেন, ‘স্যালারি পোর্টালে চাকরিহারাদের নাম সমেত তালিকা সাবমিট করা যাবে কি না, তা নিয়ে কোনও নির্দেশিকা আসেনি। এখনও তো কিছুটা সময় হাতে রয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি।’ পশ্চিম বর্ধমানের জেলা স্কুল পরিদর্শক (ডিআই) সুনীতি সাঁপুইয়ের বক্তব্য, ‘এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামত জানতে চেয়েছি। বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।’ পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির রাখালচন্দ্র বিদ্যাপীঠে চাকরি গিয়েছে পাঁচজনের।

    প্রধান শিক্ষক নির্মলকুমার আদকের কথায়, ‘পোর্টাল খুলেছে ঠিকই। তবে আমরা এখনও স্যালারির বিল পাঠাইনি। ২০ তারিখ পর্যন্ত আপাতত অপেক্ষা করছি। বিল করার সময়ে বলতে পারব, যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের নাম আছে কি না। শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে স্কুলশিক্ষা দপ্তরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শুক্রবার চাকরিহারাদের তরফে চিন্ময় মণ্ডল বলেন, ‘বেতন চালু থাকবে কি না, তা নিয়ে আইনি পরামর্শ নিচ্ছে বলে রাজ্য সরকার আমাদের জানিয়েছে। স্যালারি পোর্টাল খুলেছে, সেটা আমরা দেখেছি। তবে আমরা প্রত্যেকেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি।’

  • Link to this news (এই সময়)