এই সময়: প্রায় তিন ঘণ্টার বৈঠকে ‘যোগ্য–অযোগ্য’ বাছাই নিয়ে মিলল শুধু আশ্বাস। চাকরিহারা তথাকথিত ‘যোগ্য’ শিক্ষকরা তাঁদের চাকরি ফেরত পাবেন কি না, তার কোনও রফাসূত্র বের হলো না শুক্রবারও।
আন্দোলনরত ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের তরফে ১৩ জন প্রতিনিধি এ দিন বিকাশ ভবনে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু–সহ শিক্ষা দপ্তরের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পরে চাকরিহারাদের তরফে ওই প্রতিনিধিরা সাংবাদিক বৈঠকে জানান— আপাতত তাঁদের কয়েকটি দাবি মেনে নিয়েছেন শিক্ষাকর্তারা। তার মধ্যে একটি হলো— ‘যোগ্য’ ও ‘অযোগ্যে’র তালিকা প্রকাশ।
আগামী ২১ এপ্রিলের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশ করার কথা জানিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সালের যে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছিল এসএসসি, তার ওএমআরের প্রতিলিপি বা মিরর ইমেজ প্রকাশ করা যায় কি না, সে বিষয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়া হবে। যদি আইনি কোনও বাধা না–থাকে, তা হলে সেটাও প্রকাশ করা হবে এসএসসির ওয়েবসাইটে। বৈঠকের পরে শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য আগের মতোই শুধু বলেছেন, ‘আমরা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে ব্যাখ্যা চাইছি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এসএলপি করেছে। প্রয়োজনে রিভিউ পিটিশনে যাব। আইনি পথেই সমস্যার সমাধান হবে।’
তবে রাজ্য তাঁদের দু’টি দাবি মেনে নিয়েছে বলে চাকরিহারাদের প্রতিনিধিরা সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করলেও তা নিয়ে সন্দিহান আইনজ্ঞদের বড় অংশ। এমনকী, সল্টলেকে এসএসসি–র দপ্তরের সামনে অবস্থান–প্রতিবাদে সামিল চাকরিহারা তথাকথিত ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের বড় অংশও মন্ত্রী বা শিক্ষাকর্তাদের আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না। সূত্রের খবর, মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সেরে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিরা সেখানে গিয়ে জানান, সরকার তাঁদের দাবি কিছুটা মেনেছে।
তখন চাকরিহারাদের বড় অংশ প্রশ্ন তোলেন, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টেও একাধিক বার এসএসসি ও রাজ্য সরকার দাবি করেছিল, ‘যোগ্য–অযোগ্য’ আলাদা করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করতে পারেনি। এখন যে মিরর ইমেজ প্রকাশ করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, সেটাও তো আদতে এসএসসি–র কাছে নেই। অরিজিনাল ওএমআর শিট তো নষ্ট করেই ফেলা হয়েছে। তা হলে এখন আর ওই মিরর ইমেজে কী ভাবে নতুন করে আস্থা রাখবে কোর্ট? চাকরিহারারাই বা কোন ভরসায় থাকবেন?
সূত্রের দাবি, আন্দোলনকারীদের জিবি মিটিংয়ে অনেক চাকরিহারাই বলেন, সরকার তাঁদের সময় নষ্ট করছে। তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সরকার সদর্থক নয়। সেই কারণে এসএসসি ভবনের সামনে অবস্থান–আন্দোলন থেকে উঠতে রাজি হননি অনেকেই। সম্ভবত তাদের চাপের মুখেই চাকরিহারা শিক্ষকদের অন্যতম নেতা মেহবুব মণ্ডল বলেন, ‘আমরা উঠছি না। কারণ সরকার আমাদের যা যা বলেছে, যতক্ষণ না সেটা বাস্তবায়িত করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকব।’
কেন এত আশ্বাসের পরেও সন্দেহ যাচ্ছে না?
আইনজ্ঞদের একাংশ সুপ্রিম–রায় বিশ্লেষণ করে বলছেন, ওই রায়ের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ স্পষ্ট বলেছে, ‘এসএসসি ওএমআর শিটের স্ক্যানড কপি বা মিরর ইমেজ তাদের ইলেকট্রনিক রেকর্ডে না–রেখে তা নাইসার কাছে (ওএমআর পরীক্ষক সংস্থা) রাখতে দিয়েছিল, এটা অদ্ভুত ব্যাপার। সিবিআই আবার গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে বলেছিল, এসএসসি প্রথমে স্ক্যানড কপি বা মিরর ইমেজ রাখলেও পরে তা নষ্ট করে ফেলে।
ওএমআর শিটের স্ক্যানড কপি প্রথমে নিজেদের কাছে রেখেও পরে নষ্ট করে ফেলা— এসএসসি–র এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে মনে হচ্ছে, এটা পুরোটাই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা।’ কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে— যেখানে আসল ওএমআর শিট নেই এবং মিরর ইমেজও সংরক্ষণ করে রাখা হয়নি, সেখানে ‘যোগ্য’ ও ‘অযোগ্য’ বাছাই করা অসম্ভব।
এ দিন দুপুর তিনটের কিছুটা পরে বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়, এসএসসি–র চেয়ারপার্সন সিদ্ধার্থ মজুমদার, শিক্ষাসচিব বিনোদ কুমারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মোট ১৩ জন চাকরিহারা শিক্ষক। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেরিয়ে চাকরিহারা আন্দোলনের নেতা চিন্ময় মণ্ডল, মেহবুব মণ্ডলরা জানান, তাঁদের দাবি আংশিক মেনে নিয়েছে সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুপ্রিম–রায়ের পরে এই আশ্বাসে খুব কিছু এসে যাবে না।
কেন?
সিবিআই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে এসএসসি–র অফিস সিল করেও ২০১৬ সালের নিয়োগ পরীক্ষার ওএমআর শিটের কোনও ফিজি়ক্যাল বা ডিজিটাল কপি খুঁজে পায়নি। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, এই ওএমআরগুলি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই নিয়মবহির্ভূত ভাবে এসএসসি নষ্ট করে ফেলেছে। ওএমআরগুলি ‘নাইসা’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে মূল্যায়নের জন্য দেওয়া হয়েছিল। সংস্থাটির দুই প্রাক্তন আধিকারিকের বাড়ি–অফিসে তল্লাশি করে একাধিক হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করে সিবিআই।
তারা আরও জানতে পারে, ‘নাইসা’ আবার ‘ডেটা স্ক্যানটেক’ নামে আরও একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে সাব কনট্র্যাক্ট দিয়েছিল এই ওএমআর মূল্যায়নের জন্য। তারা আবার এসএসসির পরীক্ষায় বসা ২২ লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থীর ওএমআরের তিনটি প্রতিলিপি তৈরি করে। একটি তারা নিজেদের কাছে রাখে, অন্যটি পাঠায় ‘নাইসা’র কাছে এবং তৃতীয়টি আসে এসএসসির কাছে। তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই অবশ্য ‘ডেটা স্ক্যানটেক’ নিজের কপি নষ্ট করে ফেলে। এসএসসি–ও নিজেদের কপি নষ্ট করে ফেলে।
শুধুমাত্র ‘নাইসা’র কাছ থেকে একটি হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করে সিবিআই, যা আদালতের কাছেও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এসএসসিকে যখন আদালত জিজ্ঞাসা করে যে, এই হার্ড ডিস্কে প্রাপ্ত ওএমআরগুলি তাদেরই নিয়োগ পরীক্ষার কি না, তখন কমিশন এ ব্যাপারে নিরুত্তর থাকে। কারণ, তাদের কাছে ২০১৬ সালের ওএমআরের কোনও কপি না–থাকায়, নিশ্চিত করে বলা সম্ভব ছিল না যে ‘নাইসা’র আধিকারিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ওই ওএমআরগুলি আসল না নকল।
সিবিআই অবশ্য ‘নাইসা’র থেকে প্রাপ্ত ওএমআরের ভিত্তিতেই ৬২৭৬ জন ‘টেন্টেড’ বা ‘নিশ্চিত ভাবে অযোগ্যে’র একটি তালিকা জমা করে। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এর পরেও নিশ্চিত হতে পারেননি যে, ‘নাইসা’র আধিকারিকদের থেকে প্রাপ্ত ওই ওএমআরগুলিই আসল কি না। ফলে ‘যোগ্য’–‘অযোগ্যে’র ফারাক সিবিআই জমা করলেও তার বাইরে যে আরও কোনও ‘অযোগ্য’ নেই——এমন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আদালত পৌঁছতে পারেনি। সেই কারণেই গোটা প্যানেল বাতিল করে দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে ‘নাইসা’র থেকে প্রাপ্ত ওএমআরগুলির মিরর ইমেজ সিবিআইয়ের কাছে রয়েছে। তার একটি প্রতিলিপি এসএসসি–কেও মিলিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা এখন প্রকাশ করা যাবে কি না, করা গেলেও সুপ্রিম–রায়ের পরে তার আর কোনও গুরুত্ব আদৌ থাকবে কি না, সে বিষয়েই আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, আদালতকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি যে ডকুমেন্ট, তা প্রকাশ করে আদতে লাভের লাভটা কী হবে?
চাকরিহারাদের তরফে চিন্ময়ের বক্তব্য, ‘যোগ্য–অযোগ্যের তালিকা আমরা প্রকাশ করতে বলছি। কারণ, সরকারেরই দায়িত্ব ছিল এই তালিকা প্রকাশ করে এই মামলায় যোগ্যদের বাঁচানোর। পাশাপাশি ২২ লক্ষ ওএমআরের মিরর ইমেজ প্রকাশ করলেও বোঝা যাবে কারা দুর্নীতি করেছে আর কারা করেনি।’ আন্দোলনকারীদের তরফে আর এক প্রতিনিধি ধৃতীশ মণ্ডল বলেন, ‘ওই মিরর ইমেজ প্রকাশ করলে কী লাভ, তার কিছু উত্তর দেওয়া যায়। সেটা এখনই আমরা বলছি না। শুধু বাংলার মানুষ এটুকু আপাতত জানুক, কারা টেন্টেড, কারা টেন্টেড নন। ওই তালিকাটা প্রকাশ করলে সেটা কিছুটা স্পষ্ট হবে।’ ততদিন অবশ্য আন্দোলন চলবে বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।