• মধুমাসে বাঘের ডেরায় পাড়ি সুন্দরবনের মৌলদের, উপবাসে স্ত্রী-সন্তানরা
    এই সময় | ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময় কুলতলি: ফাল্গুন, চৈত্র আর বৈশাখ। ক্যালেন্ডারের এই তিনটে মাস হলো ‘মধুমাস’। এই সময় সুন্দরবনের গাছগাছালিগুলো ফুলে–ফলে ভরে ওঠে। সেই ফুলের মধু খেতে সুদূর হিমালয় থেকে পাহাড়ি মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে বাদাবনে।

    খলসি, গরান, গেঁওয়া, বাইন, কেওড়া, হেতাল–সহ বিভিন্ন গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাককে পরিপুষ্ট করে তোলে তারা। তাই এই সময়টার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন সুন্দরবনের মৌলেরা। যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে ঢুকে মধু সংগ্রহ করে আনেন।

    বনদপ্তরের নির্ঘণ্ট মেনে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শুরুতে মধু সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। বন দপ্তরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে নৌকোয় চেপে একে একে জঙ্গলে পাড়ি দিচ্ছেন মৌলেরা। খাস রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় তাঁরা মধু সংগ্রহে যাচ্ছেন। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে মৃত্যুও ঘটে প্রায়ই। তবু এই পেশাকে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন সুন্দরবনের মৌলেরা।

    মঙ্গলবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বন বিভাগের রায়দিঘি রেঞ্জের অধীন কুলতলি বিট অফিস থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মৌলেদের ৫৫টি দলকে মধু সংগ্রহের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এঁরা মূলত ঝড়খালি, কুলতলি, রায়দিঘি, পাথরপ্রতিমার বাসিন্দা। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সুন্দরবন জীব পরিমণ্ডলের অধিকর্তা নীলাঞ্জন মল্লিক, ডিএফও নিশা গোস্বামী ও এডিএফও অনুরাগ চৌধুরী।

    এক একটি দলে পাঁচ থেকে সাতজন করে মৌলে থাকেন। বন দপ্তরের পক্ষ থেকে এ বার মৌলেদের জন্য এক লক্ষ টাকার জনতা জীবন বিমার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বাঘের হামলার হাত থেকে বাঁচতে দেওয়া হয়েছে মুখোশ। মধুর গুণগত মান বজায় রাখতে গ্লাভস এবং মধু রাখার জন্য বিশেষ ধরনের জার দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে একটি করে ফার্স্ট এইড বক্সও দেওয়া হয়েছে।

    পুরুষরা যখন মধু সংগ্রহে জঙ্গলে যান, তখন বাড়ির মহিলারা এক পক্ষকাল মাথায় সিঁদুর পরেন না, চুলও বাঁধেন না। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উপোস করেন অনেকে। বনবিবির কাছে প্রার্থনা করেন যাতে বাড়ির লোকেরা জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। সারা দিন উপোস করার পর সন্ধ্যায় অনেকে পান্তাভাত খান। নিরামিষ খেতে হয় সপরিবার। টানা ১৫ দিন মধু সংগ্রহ করে তাঁরা ফিরে আসেন বিট অফিসে। তারপর সংগৃহীত মধু তাঁরা বিক্রি করেন বন উন্নয়ন নিগমের কাছে। ৭–১০ দিনের মধ্যে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে যায়।

    মৌলে অনাদি হালদার বলেন, ‘৪০ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করছি। ঝুঁকি আছে জেনেও পেটের দায়ে আমাদেরকে জঙ্গলে যেতে হয়।’ কুলতলির দেউলবাড়ি গ্রামের গৃহবধূ শ্রীমতী নাইয়া বলেন, ‘আমার ছেলে ও জামাই দু’জনেই গিয়েছে মধু ভাঙতে। জানি, যে কোনও সময় বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু আমরা অসহায়। বিকল্প আয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই।’

    সুন্দরবন জীব পরিমণ্ডলের অধিকর্তা নীলাঞ্জন মল্লিক জানান, এ বার দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগ এলাকা থেকে ১০ টন এবং সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকা থেকে কম করে ১৫ টন মধু মধু সংগৃহীত হবে বলে তাঁরা আশাবাদী।

  • Link to this news (এই সময়)