ওয়াকফ আইন নিয়ে শনিবারও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ধুলিয়ান এলাকা। সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। একটি বাড়িতে লুঠপাটের সময় খুন করা হয়েছে বাবা ও ছেলেকে। মৃত পিতা-পুত্রের নাম হরগোবিন্দ দাস ও চন্দন দাস। তাঁদের ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বাকি এক কিশোরের বিএসএফ-এর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলে সূত্রের খবর। শুক্রবার ওই কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে এলেও শেষরক্ষা হয়নি। দুই দিন ধরে এই সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মোট ১১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শুক্রবার মুর্শিদাবাদে উত্তপ্ত পরিস্থিতির পর থেকে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে পুলিশের সঙ্গে বিএসএফ মোতায়েন করা হয়েছিল। শনিবার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সকালেই ফের ওয়াকফ অশান্তির জেরে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ধুলিয়ান। শনিবারও বিএসএফের গুলিতে আহত হয় ২ জন। সূত্রের খবর, উত্তেজিত জনতা ধুলিয়ান পুরসভা এলাকায় ভাঙচুর শুরু করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে আহত হয়েছেন ১৮জন পুলিশ কর্মী। পুলিশ সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে। শনিবার উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফের গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে। তার জেরে ২ জন আহত হয়েছেন। সূত্রের খবর, বিএসএফের গুলিতে আহত দুইজনের মধ্যে একজনের নাম মুদ্দিন শেখ। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। এই ঘটনায় হাসান শেখ নামের আরও এক নাবালকও আহত হয়েছেন। ২ জনকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার সুতির ঘটনা ধরলে মুর্শিদাবাদে বিগত ২৪ ঘন্টায় ওয়াকফ অশান্তিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে মোট ৩ জন।
প্রসঙ্গত শনিবার কার্যত থমথমে সামশেরগঞ্জ এলাকা। রাস্তায় এখন ভারী বুটের আওয়াজ। সতর্ক নজর এখানকার অলিগলিতেও। চলছে কড়া নজরদারি। ধুলিয়ানের চারদিকে এখন ধ্বংসের চিহ্ন। পড়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া বাস, অ্যাম্বুল্যান্সের লোহার কাঠামো। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইট ও পাথর। থমথমে পরিস্থিতি সুতিতেও। সুতি ও সামশেরগঞ্জে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোট ১১৮ জনকে। শনিবার তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
এদিকে সামশেরগঞ্জে দুষ্কৃতীদের একটি দল মৃতদের বাড়িতে হানা দেয়। লুঠপাটের উদ্দেশ্যে বাড়িতে ভাঙচুর চালাতে থাকে দুষ্কৃতীরা। সেই সময় বাবা-ছেলে বাধা দিতে গেলে, তাঁদের কুপিয়ে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। দেহ দু’টি ফরাক্কা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের দেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার সময় বারবার পুলিশকে ফোন করলেও ফোনে কাউকে পাওয়া যায়নি। হামলার পর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। সব দিক খতিয়ে দেখছে তারা। পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ধুলিয়ান, সুতি ও সামশেরগঞ্জে ৭ কোম্পানি বিএসএফ মোতায়েন করা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মুর্শিদাবাদ। শনিবার সকাল থেকেই দফায় দফায় উত্তপ্ত হয় সামসেরগঞ্জের ধুলিয়ান পুরসভা এলাকা। ধুলিয়ান মোড়ের কাছে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ, দুটি গোষ্ঠীর সংঘর্ষের জেরে শুরু হয় বোমা ও গুলি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
আগের দিন শুক্রবার ধুলিয়ানের ডাকবাংলো মোড় অবরোধ করে সংখ্যালঘুরা। পুলিশ তাঁদের সরাতে এলেই শুরু হয় বচসা এবং হাতাহাতি। কিছু সময় পরে ইটবৃষ্টিও শুরু হয়। তারপর থেকেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়। তাতে অবস্থা আরও বিগড়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি বাস, অ্যাম্বুল্যান্স জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে বিএসএফ নামানো হয়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, শনিবার একটি শপিং মলে লুঠপাট চলে। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ। তার আগেই অবশ্য় দুষ্কৃতীরা তছনছ করে ফেলে। আচমকা এই হামলার কারণে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। সামশেরগঞ্জ থানার ধুলিয়ান মোড় শনিবার সকাল থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্থানীয় বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুরেরও অভিযোগ ওঠে।
উল্লেখ্য, ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে শুক্রবার বিকেল থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদ। জঙ্গিপুরের ঘটনার পর ১৬৩ ধারা অমান্য করে প্রতিবাদে নামে স্থানীয়রা। তারা ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করলে পুলিশের বাধায় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। সামশেরগঞ্জের ধুলিয়ান ডাকবাংলো ও রতনপুর এলাকায় পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ হয়। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ট্রাফিক পুলিশের অফিস। জ্বালানো হয় সরকারি-বেসরকারি বাস। বাদ যায়নি অ্যাম্বুল্যান্সও।
অন্যদিকে ফারাক্কার তৃণমূল বিধায়ক মণিরুল ইসলামকেও হেনস্তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভাঙচুর চালানো হয়েছে সামশেরগঞ্জের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি কাওসার আলির বাড়িতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটিয়ে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এখন উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় টহল দিচ্ছে বিএসএফ জওয়ানরা।
মুর্শিদাবাদের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীকেই নিশানা করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তিনি জানান, যেভাবে মুর্শিদাবাদে পরিস্থিতি বিগড়োচ্ছে, তাতে দ্রুত কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। মূলত রাজ্যের চাকরি কেলেঙ্কারি থেকে নজর ঘোরাতেই এই কাজ করছে তৃণমূল। পাল্টা বিজেপির দিকেই অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাঁর দাবি, বিজেপির উস্কানিতেই অশান্তির আঁচ বাড়ছে।