• কর্মী নগণ্য, জাল ওষুধ প্রমাণের আগেই খেয়ে ফেলছেন রোগীরা
    এই সময় | ১৩ এপ্রিল ২০২৫
  • মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ে জাল ওষুধের এক-একটি ব্যাচ। কিন্তু বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ, তার পর ল্যাবে পরীক্ষা এবং তারও পরে গুণগত মানে অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরে যত দিনে বোঝা যায় যে সংশ্লিষ্ট ব্যাচের ওষুধটি অকেজো, তত দিনে সাধারণত দু’-তিন মাস গড়িয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকরা উদ্বিগ্ন, কারণ এই তিন মাসে বাজার থেকে সেই সব ওষুধের সিংহভাগই হয়তো বিক্রির পরে ব্যবহৃত হয়ে গিয়েছে!

    কেন এমনটা হয়? স্বাস্থ্যকর্তারা একান্তে মানছেন, কী রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল, কী-ই বা কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল— সকলেই ভুগছে প্রবল কর্মিসঙ্কটে। সে জন্যই নিয়মিত ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করাই হয়ে ওঠে না দেশের কিংবা রাজ্যের সব প্রান্তের বাজার থেকে। আবার নমুনা সংগ্রহের পর দীর্ঘদিন লেগেও যায় ল্যাব টেস্টের ফলাফল মিলতে। ফলে যত দিনে ড্রাগ কন্ট্রোলের তরফে ল্যাব টেস্টে কোনও ওষুধের ফেল করার কথা জানা যায়, তত দিনে সেই ওষুধ হয়তো আর অবিক্রিত অবস্থায় পড়েই নেই বাজারে। না-জেনেই হয়তো সে সব ব্যবহার করে ফেলেছেন রোগীরা। কিন্তু বুঝতে পারেননি, কেন কাজ করলো না সে ওষুধ!

    ফলে ড্রাগ কন্ট্রোলের পরিকাঠামো নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসকরা। সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘ডাক্তার হিসেবে আমরা রোগ চিহ্নিত করে তার যথাযথ ওষুধ লিখি প্রেসক্রিপশনে। কিন্তু ভেজাল ও জাল ওষুধের যা রমরমা, সেই ওষুধ কাজ করলো কি না, সেটাও তো এখন দেখছি বড় প্রশ্ন! মুশকিল হলো, রোগ না সারলে লোকে ডাক্তারকে দুষবে! তাই ড্রাগ কন্ট্রোলের পরিকাঠামোর অভাবে যে এই সব ভুয়ো ওষুধের কারবার বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’

    কিন্তু বাস্তব বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্য, ড্রাগ কন্ট্রোলের অবস্থা সর্বত্রই ধুঁকছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ একান্তে জানাচ্ছেন, শুধু সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার কলকাতা অফিসের ছবিটা তুলে ধরলেই বোঝা যায়, সারা দেশে কী অবস্থা। কলকাতা জ়োনাল অফিসের অধীনে রয়েছে বাংলা-সহ ছ’টি রাজ্য। বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, সিকিম এবং আন্দামান ও নিকোবর এই অফিসেরই অধীনে। অথচ সব মিলিয়ে কলকাতা জ়োনাল অফিসে রয়েছেন চার জন মাত্র ড্রাগ ইনস্পেক্টর। তাঁদের পক্ষে কতদিন অন্তর বাজার থেকে ওষুধের কত নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টে পাঠানো সম্ভব, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

    রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে রীতিমতো ভ্যাকেন্সির পাহাড়। গত চার বছরের জন্য কোনও পূর্ণ সময়ের কোনও অধিকর্তাই নেই এই প্রতিষ্ঠানে। স্বাস্থ্যভবনের এক আমলাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা হিসেবে। তাঁর ঠিক নীচের পদ এবং সমান পদমর্যাদার যে একজন অতিরিক্ত অধিকর্তার পদ রয়েছে, সেটিও খালি। ৩৫ জন সহকারী অধিকর্তা থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন ২৯ জন। এবং সর্বোপরি ওষুধের উপর নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড যে ইনস্পেক্টর ও সিনিয়র ইনস্পেক্টরদের টিম, সেটাও বেনজির সঙ্কটে খোঁড়াচ্ছে। কারণ, ইনস্পেক্টরের ৯০টি অনুমোদিত পদ থাকলেও রয়েছেন মোটে ৭৭ জন। আর সিনিয়র ইনস্পেক্টর? অনুমোদিত পদ ৫০ হলেও কর্মরতের সংখ্যা শূন্য এই পদে।

    অর্থাৎ স্পষ্ট, রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে ১৮৩টি অনুমোদিত পদ থাকলেও রয়েছেন মাত্র ১১৩ জন। আর ওষুধ নিয়ে নজরদারির দায়িত্ব যে টিমের কাঁধে, সেই দলে ১৪০ জনের বদলে রয়েছেন মোটে ৭৭ জন। যার অর্থ, শূন্যপদ ৫০% ছুঁইছুঁই। অথচ ড্রাগ ইনস্পেক্টরদেরই নতুন দোকানকে লাইসেন্স দেওয়ার আগে এবং লাইসেন্স নবীকরণের আগে পরিদর্শন করতে হয়। বাজার থেকে নিয়মিত ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় পাঠানো, ব্লাড ব্যাঙ্ক পরিদর্শন, ওষুধ ও ব্লাড ব্যাগ প্রস্তুতকারী সংস্থায় পরিদর্শন, বাজারে নিয়মিত নজরদারির পাশাপাশি পুলিশ-আদালতের ঝক্কিও সামলাতে হয় তাঁদেরই। ফলে সেই ‘নিয়মিত’-এর ব্যবধানটা ঠিক কত দিনের, তা সহজেই অনুমেয়। কারণ, রাজ্যে ওষুধের দোকানের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।

    স্বাভাবিক ভাবেই জাল ওষুধ সরবরাহ ও বণ্টনের যে চোরা স্রোত ভিন রাজ্য থেকে লাগাতার সেঁধিয়ে পড়ছে বঙ্গে, তার সিংহভাগই ড্রাগ কন্ট্রোলের ধরাছোঁয়ার বাইর। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাজারে যত জাল ও ভেজাল ওষুধ ঘুরছে আর তার যতটুকু ধরা পড়ছে বলে হইচই হচ্ছে সংবাদমাধ্যম ও স্বাস্থ্য মহলে, তুলনায় গেলে তা আদতে হিমশৈলের চুড়োমাত্র।

  • Link to this news (এই সময়)