সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়া
‘চিত্ত স্যর কি আর আসবেন না?’ অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশের ছাত্রছাত্রী, সবার মুখে এই প্রশ্ন শুনে মন ভার লাগদা হাই স্কুলের শিক্ষকদের। কোনও জবাব দিতে পারছেন না তাঁরা। উত্তরই নেই শিক্ষকদের কাছে। যাঁর জন্য পড়ুয়াদের এত আকুলিবিকুলি ইতিহাসের সেই শিক্ষক চিত্তরঞ্জন মাহাতো অবশ্য স্কুলে ফেরার কথা আপাতত ভাবছেন না।
পুরুলিয়া শহর থেকে সাত কিমি দূরে বর্ধিষ্ণু গ্রাম লাগদা। পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ১৪০০। শিক্ষকের সংখ্যা ২৩। স্কুলে ইতিহাসের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন চিত্তরঞ্জন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আর স্কুলে যাননি তিনি। তাঁর অনুপস্থিতি প্রভাব ফেলেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক, সবার মধ্যেই। পুরুলিয়ার হুড়ার পালগামের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন শিক্ষকতা করার আগে একটি কলেজে আংশিক সময়ের শিক্ষকও ছিলেন। লাগদা হাই স্কুলে যোগ দিয়েই বিপুল জনপ্রিয়তা পান ছাত্রছাত্রীদের কাছে।
স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক কমলেশ আচার্য বলেন, ‘যে কোনও প্রয়োজনে বিনা বাধায় পড়ুয়ারা তাঁর কাছে চলে যেত। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হোমলি ব্যবহার করতেন। মিড–ডে মিলের থালা না থাকার মতো সমস্যাও শুনতেন মন দিয়ে। পড়ানোর বাইরে আরও নানা কাজে সব সময়ে যুক্ত থাকতেন। ছাত্রছাত্রীরা খুব বিমর্ষ, আমাদেরও মন খারাপ। উনি যোগ্য শিক্ষক ছিলেন এতে কোনও সন্দেহ নেই। দ্রুত তাঁদের নেওয়া হোক, এটাই চাই।’ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নকুল সিং মুড়ার কথায়, ইতিহাসের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন তিনি। ষষ্ঠ থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় একার হাতে সামলাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘উনি না থাকায় ইতিহাসের ক্লাস নিয়ে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে স্কুল। পড়ুয়াদের উদাসী মুখের কাছে আমরা অসহায় হয়ে গিয়েছি।’
হতাশ পড়ুয়ারাও। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র অক্ষয় মাহাতো বলে, ‘স্যারকে মনে পড়ছে বার বার। কত সুন্দর ভাবে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। উনি ফের ফিরে আসুন।’ ছাত্রী সঞ্জু রাজোয়ার ও শিউলি রাজোয়ারের কথায়, ‘স্যার না থাকলে কী ভাবে সামনের সেমেস্টারে ইতিহাস পরীক্ষা দেবো সেটাই বুঝে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে নিজের বাড়ির কেউ চলে গিয়েছে।’ চিত্তরঞ্জনকে মিস করছেন প্রধান শিক্ষক অর্চিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘আট বছর ধরে শিক্ষকতা করার পরে হঠাৎ এ ভাবে চলে যাওয়া খুব দুঃখের। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক নয়, উনি মাধ্যমিক স্তরেও ক্লাস নিতেন। স্কুলের এত ক্লাস কী ভাবে সামলানো হবে তা নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তায় রয়েছি। খুব মিস করছি ওঁকে।’
ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনে মন ভালো নেই চিত্তরঞ্জনেরও। আপাতত স্কুলে ফেরার কোনও সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। বলেন, ‘যা হয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা সবাই একসঙ্গেই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যা সিদ্ধান্ত হবে সেই মতোই করব।’ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে তিনি শুধু বলেন, ‘ওরাই ছিল আমার জগৎ। ভালো হোক সবার। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। পড়াশোনায় ঢিলে দেওয়া চলবে না। সুসময় আসবে, তখন আবার দেখা হবে।’