এই সময়: মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে যেখানে ৩০ জন পিছু একজন শিক্ষক থাকার কথা, সুপ্রিম-রায়ে একলপ্তে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি খারিজের পরে সেই অনুপাতটা হয়ে গিয়েছে ৫৮:১। বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতটা পৌঁছে গিয়েছে কোথাও ১৩১:১, কোথাও ২৫৭:১, কোথাও বা ৯৬৩:১-এ।
এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাজ্য প্রশাসনের বারংবার আশ্বাস সত্ত্বেও তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষকরা এই মুহূর্তে শুধু ‘ভলান্টারি সার্ভিসের’ জন্য স্কুলে যেতে রাজি নন বলে রবিবার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তা হলে আজ, সোমবার থেকে শুরু হওয়া নতুন সপ্তাহে ক্লাস চলবে কী ভাবে? কী ভাবেই বা সিলেবাস শেষ হবে? এ সব নিয়ে ঘোরতর দুশ্চিন্তায় রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের কর্তারা।
‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের ঘোষণার প্রেক্ষিতে রবিবার বিকাশ ভবনের কর্তারা কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে আপাতত চলতি সপ্তাহটা তাঁরা সামান্য ‘স্বস্তি’তে থাকছেন। কারণ, আজ বাবা সাহেব আম্বেদকরের জন্মদিন ও আগামিকাল, পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে স্কুলগুলিতে সরকারি ছুটি।
আবার গুড ফ্রাইডের ছুটি রয়েছে শুক্রবার। তার মধ্যে আগামী বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দায়ের করা স্পেশাল লিভ পিটিশনের শুনানি হতে পারে সুপ্রিম কোর্টে। সে দিন যদি পর্ষদের আর্জি বিবেচনা করে শীর্ষ আদালত আপাতত এই ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের কাজ করে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে সমস্যাটা সাময়িক ভাবে মিটতে পারে। আর তা না-হলে?
এর জবাবটাই সবচেয়ে কঠিন শিক্ষাকর্তাদের কাছে। পর্ষদের এক আধিকারিক বলছেন, আপাতত যে সব স্কুলে হাতেগোণা কিছু শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে, সেখানে অন্য শিক্ষকরা তাঁদের ক্লাস সামাল দিচ্ছেন। কোথাও আবার বিভিন্ন ক্লাসে একাধিক সেকশনকে ‘ক্লাব’ করে ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনাও করছেন প্রধান শিক্ষকরা। তবে যে সব স্কুলে ১৮ জনের মধ্যে ১৩ জন অথবা ২৭ জনের মধ্যে ২৫ জনেরই চাকরি খারিজ হয়েছে, সেখানে কী হবে?
সেই সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা ইতিমধ্যে পরিস্থিতির কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা স্কুল পরিদর্শক বা ডিআই-দের চিঠি দিয়েছেন। এখনই হাতের সামনে কোনও সমাধানসূত্র তাঁরাও দিতে পারছেন না। কোথাও কোথাও ক্লাস ফাঁকা থাকলে প্রধান শিক্ষকরাই ওই পড়ুয়াদের ‘সিট অ্যান্ড রিড’ অর্থাৎ নিজেরা সংশ্লিষ্ট পিরিয়ডের বই খুলে পড়তে বলছেন। রবিবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক আধিকারিক বলেন, ‘আমরা স্কুলগুলোর এই অবস্থার কথা মাথায় রেখেই তো সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছি। আমরা বলেছি, স্কুলগুলোতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। এখনই বিকল্প কোনও পথ আমাদের হাতে খোলা নেই।’
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের কথায়, ‘এসএসসি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করে। নিয়োগ করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। এখনকার পরিস্থিতিতে কী ভাবে ক্লাস নেওয়া হবে সেটা স্কুলশিক্ষা দপ্তর, স্কুলশিক্ষা কমিশনার এবং পর্ষদ নিশ্চয়ই দেখবে। তবে আমাদের একটা পরামর্শ আছে। সেটা হলো— স্কুলগুলোকে যদি এলাকাভিত্তিক ভাবে ক্লাস্টার করে আপাতত চালানো যায়।’
সেটা কেমন? সংসদ সভাপতির ব্যাখ্যা, ‘কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় যে স্কুলে কোনও বিষয়ের শিক্ষক নেই, পাশের স্কুল থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষককে সেখানে আপাতত নিয়ে গিয়ে কিছু ক্লাস করানো যেতে পারে। আবার অন্য কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রে উল্টো কাজটা করা যায়।’ যদিও একটি স্কুলের শিক্ষক পাশের স্কুলে গিয়ে ক্লাস নেবেন কোন নির্দেশের ভিত্তিতে, সেটাও ভাবতে হবে পর্ষদকে।
এর বাইরেও প্যারাটিচার ও আংশিক সময়ের শিক্ষকের সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো যায় কি না, সেটাও বিবেচনার মধ্যে রাখা হচ্ছে। বিকাশ ভবন সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে রাজ্যের স্কুলগুলিতে ৫০ হাজারের মতো প্যারাটিচার আছেন। তাঁদের অবশ্য পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস নেওয়ার কথা। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁদের যোগ্যতামান আছে, তাঁদের আপাতত উঁচু ক্লাসে পড়ানোর ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্কুলগুলিতে গড়ে চার-পাঁচজন করে আংশিক সময়ের শিক্ষক আছেন। সংসদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্কুলগুলি যাতে সেই সংখ্যাটা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতে পারে, সেটাও দেখা হচ্ছে।
এই টানাপড়েনের মধ্যেই রবিবার এসএসসি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৬-এর বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে যে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর প্যানেল তৈরি হয়েছিল, অর্থাৎ যাঁদের নাম এসএসসি নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল— সেই তালিকা বিকাশ ভবনে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে ৬,২৭৬ জন ‘টেন্টেড’ এবং বাকি প্রায় ১৯ হাজার তথাকথিত ‘যোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর নাম রয়েছে। সূত্রের দাবি, সুপ্রিম কোর্টে যে রিভিউ পিটিশনের কথা ভাবছে রাজ্য সরকার, সেই সূত্রেই এই তালিকা ৈতরি রাখা হচ্ছে।