• আশ্রয়ের খোঁজে নদী পেরিয়ে মালদায়, ঠাঁই মিলল স্কুলঘরে
    এই সময় | ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • কৌশিক দে, মালদা

    মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। চলে এসেছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নিজে। তৈরি হয়েছে রাজ্যের দক্ষ আইপিএস-দের নিয়ে স্পেশ্যাল টিমও। কিন্তু এত কিছুর পরেও সাহস করে আর মুর্শিদাবাদে থাকতে পারছেন না বহু মানুষ। ভাগীরথীতে খেয়াপার করে তাঁরা আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন মালদায়।

    সকলেরই বক্তব্য — এখন না হয় বাহিনী, পুলিশ রয়েছে। কিন্তু কত দিন থাকবে? তারা চলে যাওয়ার পরে কী হবে? তাই ভবিষ্যৎ ঘোরতর অনিশ্চিত বুঝেও প্রাণ হাতে ভিটেমাটি ছেড়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এসেছেন মুর্শিদাবাদের একাধিক গ্রামের মানুষ। তাঁদের পিছু পিছু আসছেন আরও অনেকে।

    ভাগীরথীর একদিকে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, ডাকবাংলো, সামশেরগঞ্জের মতো এলাকা আর অন্যদিকে বড় অংশে মালদার বৈষ্ণবনগর। হিংসা থেকে বাঁচতে নদী পেরিয়ে এখন এই বৈষ্ণবনগরেই এসে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ। আপাতত তাঁদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে একটি স্কুলে। অনেকে আবার আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়দের বাড়িতে। রবিবার সকাল থেকে বৈষ্ণবনগরের খেয়া ঘাটে তুমুল ব্যস্ততা।

    একের পর এক যাত্রী-বোঝাই নৌকা আসছে ওপার থেকে। তাতে কাতারে কাতারে মানুষ। কোলের শিশু থেকে চলাফেরায় প্রায় অক্ষম প্রবীণ — রয়েছে সকলেই। তাঁরা পিছনে ফেলে এসেছেন ঘরবাড়ি-জমি, এমনকী গৃহপালিত প্রাণীগুলিকেও। মালদার মাটি ছুঁয়ে সকলের মুখে এক কথা — ‘ফিরব কীসের ভরসায়? এত পুলিশ, বাহিনী রয়েছে। তবুও তো হামলা হলো।’

    মালদা জেলা প্রশাসনের তরফে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে পারলালপুর হাইস্কুলে। মালদার (সদর) মহকুমাশাসক পঙ্কজ তামাং বলেছেন, ‘মুর্শিদাবাদ থেকে কিছু মানুষ নৌকা করে নদী পেরিয়ে বৈষ্ণবনগরের পারলালপুরে এসেছেন। এলাকার স্কুলে তাঁদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই ক্যাম্পে ১৭০ জন রয়েছেন। তাঁরা প্রধানত ধুলিয়ান থেকে পালিয়ে এসেছেন।’ এসডিও জানিয়েছেন, সকলের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাখা হয়েছে পুলিশের একটি টিমও। এ ছাড়া আর যা যা সাহায্য প্রয়োজন, জেলা প্রশাসনের তরফে সবই করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।

    পারলালপুরের রূপচাঁদ মণ্ডলের বয়স ৬০ পেরিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খেয়া পারাপার করা এই মাঝি বলছেন, ‘ধুলিয়ানে আমার মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিরা রয়েছে। ওদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে, সব কিছু লুট করেছে দুষ্কৃতীরা। কোনওক্রমে ওদের বাঁচাতে পেরেছি।’ তবে রবিবার ভোর থেকে তাঁকে বহুবার নদীর এপার-ওপার করতে হয়েছে। বলছেন, ‘ওপার থেকে লোক এসেই যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষের কাছে ভাড়া দেওয়ার মতো টাকাও নেই। এমন দিন আগে কখনও দেখিনি।’

    দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব বন্ধ হচ্ছে না কেন? কী করছে প্রশাসন?

    প্রশ্নটা রাখতেই ধুলিয়ান থেকে আসা বছর সত্তরের এক বৃদ্ধার ক্ষোভ ঝরে পড়ল — ‘ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল। সব কেড়ে নিয়ে গেল। সাহায্য করতে কেউ এল না। ছেলে, বৌমা আর নাতিটাকে নিয়ে কোনওক্রমে পালিয়ে এসেছি।’ ধুলিয়ানের বেদবনা এলাকার এক যুবক বললেন, ‘ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। গোরু, ছাগল পর্যন্ত লুট করেছে। ট্যাঙ্কের জলে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে।’

    এক তরুণীর প্রশ্ন, ‘এ ভাবে মানুষের উপরে অত্যাচার চালানোর নাম আন্দোলন? তাণ্ডব বেড়েই চলেছে দিনে দিনে।’ তাঁর থেকে কথা কেড়ে পাশে দাঁড়ানো এক গৃহবধূ বললেন, ‘গত তিন-চার দিন ধরে বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। চাল নেই, রান্নার গ্যাস নেই।’ মালদার পারলালপুরের বাসিন্দা শ্রীমন্ত বিশ্বাস বলেন, ‘ধুলিয়ান, সুতি, সামশেরগঞ্জ থেকে দলে দলে লোক আসছেন। ওঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এ রকম ঘটনা আগে দেখিনি। যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, তত দিন এই মানুষগুলোর পাশে আছি।’

  • Link to this news (এই সময়)