টবে বসানো গাছগুলোর নিয়মিত পরিচর্যার পর ভক্তিভরে ওরা সবাই মিলে প্রণাম করে গাছগুলোকে। আশীর্বাদ চেয়ে প্রার্থনা করে — ‘যত অনাচার এবং অত্যাচারই হোক না কেন, তোমরা যেন আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা বন্ধ কোরো না।’
উত্তর কলকাতার ছিদাম মুদি লেনে তৈরি এই ‘গাছ মন্দির’–এর পূজারি তীর্থরাজ মণ্ডল, বাদল চন্দ্র, মলয় চক্রবর্তী এবং সৌমিক বসুর মতো কয়েক জন। ওঁরা অন্য অনেকের মতো ‘স্বাভাবিক’ নন। কিন্তু বিশেষ ভাবে সক্ষম তকমা পাওয়া এই কিশোর ও তরুণরা নীরবে এবং নিয়মিত ভাবে যে কাজ গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন, সেটা যদি সবাই করতেন তা হলে পৃথিবী আরও অনেক সুন্দর হতে পারত।
পৃথিবীতে যত রকমের জীবিত উপস্থিতি রয়েছে, তাদের সবার মধ্যে সবচেয়ে ‘সভ্য’ হলো উদ্ভিদ। একমাত্র গাছই তার কর্মকাণ্ডের দ্বারা পৃথিবীর কোনও ক্ষতি করে না— গাছ সম্পর্কে এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ রিচার্ড সেন্ট বার্ব বেকার।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো নিজের উপস্থিতি দিয়ে সব রকম ভাবে পৃথিবীর উপকার করে যাওয়া এই উদ্ভিদের উপরে সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয়। উন্নয়নের নামে দেদার বৃক্ষনিধন তো প্রতিদিনের ঘটনা। আর ‘প্রিয় সন্তানের’ উপর এমন অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতেও দেরি করেননি প্রকৃতি দেবী। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া — পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে এই সব কিছুই গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফল।
উত্তর কলকাতার জনকল্যাণকারী সংস্থা ‘সংবেদন’ বহু বছর ধরেই বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নিয়ে কাজ করে চলেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে সমিত সাহা ‘এই সময়’–কে বলেন, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নানা ধরনের সৃষ্টিশীল কাজে ব্যস্ত রাখা ওদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য উপযোগী। তাই আমরা ‘গাছ মন্দির’–এর পরিকল্পনা করেছি।’ সমিত জানাচ্ছেন, যাঁরা গাছ ভালোবাসেন, কিন্তু জায়গার অভাবে গাছ লাগাতে পারেন না, তাঁরা চাইলেই তাঁদের কোনও প্রিয়জনের নামে একটি গাছ এই ‘গাছ মন্দির’–এ দান করতে পারেন।
‘সংবেদন’–এর বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষগুলোই সেই গাছ সযত্নে বড় করার ভার নেবেন। গাছ বেশি বড় হয়ে গেলে সেগুলো পোঁতা হবে পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার বিভিন্ন জায়গায়। এ ভাবেই পরিবেশের অক্সিজেনের জোগান বহাল থাকবে। ‘সংবেদন’ জানাচ্ছে, প্রতিটা গাছ আসলে এক একটি ‘অক্সিজেন ব্যাঙ্ক’ হিসেবে আচরণ করে। এমনটাই শিখিয়ে তাঁদের পরিবেশরক্ষার কাজে সামিল করা হয়েছে।
সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চাইলেই সংস্থা নিজের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করতে পারে। কিন্তু তেমন করলে সেই উদ্যোগে সমাজের সব স্তরের মানুষের কোনও ভূমিকা থাকবে না। যাতে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে পরিবেশরক্ষার এই প্রয়াসে সবার ভূমিকা থাকে, তার জন্যই ‘গাছ মন্দির’–এ বৃক্ষ দানের ব্যবস্থা।