• ঘাটে জড়ো হওয়া ভিড়ের কাছে ‘দেবদূত’ রূপচাঁদ
    এই সময় | ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • কৌশিক দে ■ মালদা

    নদীর ও পারে থিকথিকে ভিড়। এ পার থেকে খানিকটা ভুরু কুঁচকে কপালের উপরে হাত রেখে ঠাহর করছিলেন রূপচাঁদ মণ্ডল।

    আগে এমনটা দেখেননি। নদী পারাপার তাঁর বহু দিনের পেশা। ভোরে এসে ভেসে পড়েন ভাগীরথীতে। তাঁর খেয়াল–খুশির দোলে এ পারের মালদা থেকে ও পারে মুর্শিদাবাদে যাতায়াত করেন বহু মানুষ। কিন্তু, রবিবার সকাল ছ’টায় এসে মালদার বৈষ্ণবনগরের পারলালঘাট থেকে যত মানুষ দেখলেন ও পারে, তত মানুষকে এত সকালে নদীর পাড়ে অপেক্ষা করতে দেখেননি ষাটোর্ধ্ব রূপচাঁদ।

    ভাগীরথীর ও পারে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান ঘাট। এত যাত্রী দেখে মনে মনে বুঝি খুশিই হয়েছিলেন রূপচাঁদ। ভেবেছিলেন, দু’পয়সা বেশি কামাই হবে আজ। নৌকো নিয়ে ভেসে যান ভোরের ভাগীরথীতে। আর ও পারে পৌঁছতেই ভুল ভাঙে তাঁর। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির দু’চোখ জুড়ে আতঙ্কের ছায়া। তাঁরা কোনও ভাবে নদীপথে পালিয়ে যেতে চাইছেন। সেই দলে বৃদ্ধ–বৃদ্ধা, জোয়ান–যুবতী, বাচ্চা–কাচ্চা — সবাই আছেন। বোধকরি রাতভোর থেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন নৌকোর আশায়।

    রূপচাঁদকে দেখে আকুল হয়ে ওঠে মানুষগুলো। দুলে ওঠে পাড়। সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠতে চান রূপচাঁদের নৌকোয়। সবাই একসঙ্গেই চলে যেতে চান ধুলিয়ান ছেড়ে। ঘরদোর, ভিটেমাটি, প্রিয় পোষ্যদের ফেলে আসা এই অসহায় মানুষগুলোর থেকে পারাপারের জন্য টাকা নেবেন কী করে তিনি? চেয়ে দেখেন, সেই ভিড়ে তাঁর মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনিরাও দাঁড়িয়ে। তাঁরাও মালদায় যেতে চান। তাঁদের মুখ–চোখেও সেই ভয়ের ছবি। সবার আগে কি নিজের মেয়ে–জামাইকে নিয়ে যাবেন? কিন্তু, রূপচাঁদ তো সেরকম মানুষ নন! তাই, তাঁর মেয়ে–জামাইকে অপেক্ষা করতে হয় খেয়াঘাটে। তাঁদের বসিয়ে রেখে আগে অন্য গ্রামবাসীদের নদী পার করান রূপচাঁদ। ভাড়া নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। সেই সকাল থেকে এ ভাবে প্রায় ২০ বার নৌকা নিয়ে এ পার–ও পার করেছেন বৃদ্ধ মাঝি। সবার শেষে ধুলিয়ান থেকে ফেরার পথে নৌকোয় তুলেছেন মেয়ে–জামাইদের।

    পারলালপুরেই বাড়ি রূপচাঁদের। নৌকো চালিয়ে সংসার টানেন। বলেন, ‘পারলালপুরের ঘাটে গিয়ে নৌকো খুলতে গিয়ে হঠাৎ দেখি, ধুলিয়ান ঘাটে প্রচুর মানুষের ভিড়। ভেবেছিলাম দু’টো বাড়তি রোজগার হবে হয়তো। কিন্তু, ও পারে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে হাত পেতে পয়সা নিতে পারিনি।’ এ দিনই জানতে পারেন মুর্শিদাবাদের অশান্তির কথা। হুড়োহুড়ি করা মানুষগুলোকে আশ্বস্ত করেন। তারপরে দফায় দফায় যাত্রীদের নিরাপদে পারলালপুরে নিয়ে আসেন।

    রূপচাঁদের নৌকোয় এ পারে আসা মহিলাদের কথায়, ‘স্বামীরা দিনমজুরি করেন। এই অশান্তিতে কয়েকদিন ধরে বাইরে যেতে পারেননি। তারপরে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব। বাড়িতে ইট, পাথর ছুড়ে টিন, টালির ছাদ ভাঙচুর করা হয়েছে। গবাদি পশু লুঠ করেছে। ভেবেছিলাম হয়তো বাঁচব না। বাড়ি থেকে পালিয়ে ভোরে নদীঘাটে আসি। দেবদূতের মতো আমাদের কাছে ওই নৌ-চালক এসে হাজির হন।’ মহিলারা জানান, ঘাটে নামিয়ে ওই স্কুলটিও দেখিয়ে দিয়েছেন রূপচাঁদ, যেখানে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন। তৃণমূল পরিচালিত মালদা জেলা পরিষদের সদস্য পরিতোষ সরকার বলছেন, ‘রূপচাঁদ একজন সহজ সরল মানুষ। তাঁর এই কাজকে প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে।’ পরিতোষ জানিয়েছেন, পারলালপুর হাইস্কুলে আশ্রয় নেওয়া সবাইকে সবরকম ভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রশাসনের কর্তারাও এসে দেখে গিয়েছেন।

    আর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে রূপচাঁদ বললেন, ‘এতগুলো মানুষকে নিরাপদে আনতে পেরেছি। এটাই তো বড় পাওনা। দেখবেন, এই অশান্তি মিটে যাবে।’

  • Link to this news (এই সময়)