এই সময়: তাঁদের স্কুলে ফেরার জন্য বারবার আবেদন জানিয়েছে রাজ্য সরকার। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এঁদের চাকরি বহাল রাখার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন, কাজে যোগ দেওয়ার আবেদনও জানিয়েছেন। কিন্তু চাকরিহারা শিক্ষকরা রবিবার ঘোষণা করে দিলেন যে, স্কুলে তাঁরা ফিরছেন না। এঁদের বক্তব্য — ‘বিনা দোষে চাকরি হারিয়েছি। এখন আর ‘মাথা নিচু করে’ স্কুলে যেতে চাই না। নিজেদের হকের চাকরি ফিরে পেয়ে সসম্মানে ক্লাসে ফিরতে চাই।’
এ দিন ধর্মতলার ধর্নাস্থল থেকে এই শিক্ষকদের সংগঠন ‘যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’–এর তরফে চিন্ময় মণ্ডল বলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। বেশিরভাগ শিক্ষকই জানিয়েছেন, তাঁরা এ ভাবে স্কুলে ফিরতে চান না। তাই আমাদের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করছি, কেউ স্কুলে ফিরছি না।’ পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষক–শিক্ষিকারা তাঁদের আগামী দিনের একাধিক কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। আজ, সোমবার দিল্লির উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন এঁরা। এ বাদে রাজভবন অভিযানের পরিকল্পনা আছে। এবং আগামী ৭ মে–র মধ্যে চাকরি ফিরে না পেলে আমরণ অনশন শুরু করবেন এই টিচাররা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গিয়েছে। তার পরেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে এঁদের আশ্বস্ত করে স্কুলে ফেরার আহ্বান জানিয়েছিলেন মমতা। স্কুলে ‘ভলান্টারি সার্ভিস’ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘দু’মাস একটু কষ্ট করুন। আগামী ২০ বছর নিশ্চিন্তে থাকবেন।’ তার পরেই অবশ্য শিক্ষকদের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন যে, শুধু মুখের কথায় তাঁরা স্কুলে ফিরতে চান না।
ইন্ডোরের ওই বৈঠকের পরে গত শুক্রবার বিকাশ ভবনে এঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। সেখানেও বারবার স্কুলে ফেরার আবেদন জানানো হয় কর্মহারাদের। তবে আবেদনে সাড়া দিলেও তাঁরা স্যালারি পাবেন কি না, কোন ভরসায় ক্লাসে ফিরবেন, সে সব নিয়ে কোনও আলোকপাত করতে পারেনি সরকার। বরং শিক্ষকদের ‘সামাজিক দায়িত্ব’ পালনের ডাক দেওয়া হয়। আর মেলে ‘আইনি পরামর্শ’ নেওয়ার আশ্বাস।
কিন্তু সরকারের এমন সব কথা যে তাঁরা শুনছেন না, সেটা রবিবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন চাকরিহারারা। চিন্ময় বলেন, ‘রায়ের পরেও আমাদের মধ্যে বেশ ক’জন স্কুলে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাচ্ছিল্যের মুখে পড়তে হয়েছে এঁদের অনেককে।’ কী রকম তাচ্ছিল্য? শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, অভিভাবক–ছাত্রছাত্রীদেরই একাংশ তাঁদের ‘চাকরি চলে গিয়েছে’ বলে কটাক্ষ করেছেন। আবার, সমবেদনা জানানোর নামে কেউ কেউ বেঁকা কথাও বলেছেন। অনেক স্কুলে তাঁদের সাদা কাগজে সই করতে বলেছেন প্রধান শিক্ষকরা। এই পরিস্থিতিতে সংগঠনের বক্তব্য, ‘আমরা এত তাচ্ছিল্যের পাত্র নই। আমাদের দোষে চাকরি যায়নি। মাথা উঁচু করে স্কুলে ফিরতে চাই। তাই যতদিন না চাকরি ফেরত পাচ্ছি, আমরা কেউ স্কুলে যাব না।’
কিন্তু সরকারের সঙ্গে তো তাঁদের আলোচনা চলছে। শিক্ষামন্ত্রীও দিন কয়েক আগে প্রশ্ন তোলেন যে, আন্দোলন এবং আলোচনা এক সঙ্গে কী ভাবে চলতে পারে! এই পরিস্থিতিতে গভর্নমেন্টের স্কুলে ফেরার আবেদনে সাড়া না দিলে কথাবার্তার পথে সমস্যা দেখা দেবে না তো? চিন্ময়ের জবাব, ‘আলোচনা তো সরকারকে করতেই হবে। আমরাও সেটা চাই। কিন্তু তা বলে আমাদের আন্দোলন কী ভাবে চলবে, সেটা সরকার ঠিক করে দেবে না। অনেক আলোচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মূল মঞ্চের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিভিন্ন জেলার কর্মহারারাও। যে শিক্ষকরা সরাসরি আন্দোলন মঞ্চের সঙ্গে জড়িত নন, তাঁরাও স্কুলে যাবেন না বলে জানাচ্ছেন। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের চাকরিহারা শিক্ষিকা প্রিয়াঙ্কা গোহের কথায়, ‘কন্যাশ্রীর পেন্ডিং কাজগুলো স্কুলে গিয়ে কমপ্লিট করে দিয়েছি। এখন হয়তো অন্য কেউ সেই দায়িত্ব পালন করবেন। চাকরি যাওয়ার পরেও স্কুলে পরীক্ষার গার্ড দিতে গিয়েছিলাম। আর যাব না।’ পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার চাকরিহারা শিক্ষক কার্তিক আদক বলছেন, ‘মঞ্চ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে সমর্থন জানাই। যতদিন না আদালত আমাদের স্কুলে যেতে বলছে, ততদিন যাব না।’ পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের চেলিয়ামা বিজলিপ্রভা উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্মহারা টিচার তথা যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের পুরুলিয়ার সক্রিয় কর্মী বিজয় মাহাতো বলেন, ‘মঞ্চের নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গেই আছি। আপাতত স্কুলে যাব না।’
এ নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও। তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় চাকরিহারাদের এই সিদ্ধান্তকে ‘দুভার্গ্যজনক’ বলছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকার তো সবরকম ভাবে ওঁদের পাশে আছেন। স্কুলে যেতে অনুরোধও করা হয়েছিল তাঁদের। তারপরেও যদি তাঁরা কথা না রাখেন, সেটা দুঃখজনক। ওঁরা রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন না বলেই বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু ওঁদের কাজকর্ম দেখে সেটা মনে করা কঠিন হচ্ছে।’ চাকরিহারাদের উদ্দেশে সৌগতর বার্তা, ‘অনেকে আপনাদের উস্কানি দিতে আসবেন, কিন্তু চাকরি ফেরাতে পারবেন না। তাই সরকারের উপরে আস্থা রাখুন।’ এ ব্যাপারে অবশ্য চেষ্টা করেও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্টো দিকে, বিজেপি–র রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য এ জন্য সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘আরজি কর আন্দোলনের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, উৎসবে ফিরুন। মানুষ ফেরেনি। উনি তারপর বললেন, স্কুলে ফিরুন। শিক্ষকরা ফেরেননি। আসলে মানুষ বলছে, ২০২৬ উনিও আর নবান্নে ফিরছেন না।’