• ‘স্যর আমরা কী করেছি?’ আকুতিই ফেরায় ক্লাসে
    এই সময় | ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • অর্ঘ্য ঘোষ ■ ময়ূরেশ্বর

    উদ্বেগে সে দিন স্কুলে যেতে পারেননি। রায় শুনে মুষড়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন সুষ্ঠু সমাধান কিছু না হওয়া পর্যন্ত আর স্কুলমুখো হবেন না। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে সেই সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে দেয়নি। বারবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে, 'স্যর আমরা কী দোষ করেছি? আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন কেন?' সেই আকুতি নাড়িয়ে দেয় শুভদীপ পালকে। তাদের ভালোবাসার টানে স্কুলে ফিরেছেন তিনি।

    বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের বাসিন্দা বছর তেত্রিশের শুভদীপ ২০১৯ সালে নানুর সংলগ্ন পূর্ব বর্ধমানের গোন্নাসেরান্দি হাইস্কুলে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ৫৫০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য ওই স্কুলে বরাদ্দ ছিল ১৭ জন শিক্ষক। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁদের মধ্যে চাকরি গিয়েছে একমাত্র শুভদীপের। আর তাতেই বেশ বেকায়দায় পড়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কারণ শুধু পড়ানোই নয়, খেলাধুলো থেকে সংস্কৃতি — এত দিন সব কিছুরই দায়িত্ব সামলেছেন শুভদীপ। সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে।

    ওই স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগের অনুমোদন নেই। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলে স্কুল ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না পড়ুয়াদের। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে শুভদীপকে। তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার প্রস্তাব রাখেন। কর্তৃপক্ষ তাঁকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার দায়িত্ব দেন। সেই দায়িত্ব পাওয়ার পরে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি সমেত অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে তোলেন। সেই পরিকাঠামো সরকারি পরিদর্শনে প্রশংসাও পেয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, বিজ্ঞান বিভাগের অনুমোদন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

    স্বভাবতই এমনএক শিক্ষককে হারাতে রাজি নয় ছাত্রছাত্রীরা। দশম শ্রেণির ছাত্রী সুপর্ণা সূত্রধর, পৌলমী ঘোষ, নবম শ্রেণির সৌমাল্য ধারারা জানায়, 'স্যরকে আমরা সবেতেই পাশে পাই। তিনি স্কুলে আসবেন না, তা ভাবতেই পারছি না।' একই কথা শোনা গেল প্রাক্তনীদের মুখেও। খুজুটিপাড়া হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সুখেন থান্দার, নানুর হাইস্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুরজিৎ মণ্ডলরা বলছে, 'বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য মাধ্যমিকের পরে স্কুল ছেড়ে আসতে হয়েছিল। কিন্তু স্যরের সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ হয়নি। পড়াশোনার ব্যাপারে যখনই কোনও সমস্যায় পড়েছি, স্যরের কাছে ছুটে গিয়েছি অথবা ফোন করেছি। স্যর হাসিমুখে সমাধান করে দিয়েছেন। একটুও বিরক্ত হননি।'

    স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিমাদ্রিশেখর গুপ্ত–র কথায়, 'তাঁর মতো ছাত্রদরদী শিক্ষক কমই হন। স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করতে তিনি ভীষণ ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন।'

    শুভদীপের আয়ের উপরেই চার জনের সংসার চলে। মাত্র মাস দুয়েক আগে বিয়ে করেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছেন। মাসে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে নলহাটির লোহাপুর এমআরএম হাইস্কুলে নবম–দশমের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। নভেম্বরে সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন গোন্নাসেরান্দিতে। তা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আপার প্রাইমারি, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টাফ সিলেকশন কমিশন, ডব্লিউবিপিএইচসি–তে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। আপাতত বাড়িতে টিউশন শুরু করেছেন।

    গলায় ঝরে পড়ল আক্ষেপের সুর — 'ছাত্রছাত্রীদের টানে স্কুলে যেতেই হবে। বাড়ি থেকে মোটরবাইকে ১৯ কিমি দূরের স্কুল যেতে একটা খরচ তো আছেই। যতদিন কিছু সমাধান না হয়, ততদিন কোনও রকমে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাব।'

  • Link to this news (এই সময়)