• সকলেই ‘রাজনীতিক’ নন, কেউ কেউ শতাব্দী-লকেট, পঠানেরা কেন দৈনন্দিন রাজনীতির মাঠে বাউন্ডারির বাইরেই থেকে যান!
    আনন্দবাজার | ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ অর্থাৎ, কবিতা লিখলেই বা কবি অভিধা প্রাপ্ত হলেই কেউ ‘কবি’ হয়ে যান না। তেমনই ‘খ্যাতনামী’ হলেও সকলেই ‘রাজনীতিক’ নন, কেউ কেউ রাজনীতিক। বস্তুত, খ্যাতনামী হিসেবে রাজনীতিতে পা রেখে পুরোদস্তুর রাজনীতিক হওয়া মুশকিল কি না, তা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক যে আগে হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেই পুরনো বিতর্কে নতুন অক্সিজেন জুগিয়েছেন ইউসুফ পঠান।

    প্রাক্তন ক্রিকেটার (অধুনা প্রাক্তনদের ‘লেজেন্ডস লিগ’-এ খেলেন) ইউসুফকে এনে বহরমপুর আসনে দাঁড় করিয়েছিল তৃণমূল। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, দাঁড় করিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্রিকেটার হিসেবে সফল হলেও যে ইউসুফ রাজনীতির ময়দানে একেবারেই অজ্ঞাতকুলশীল ছিলেন। অভিষেকের সে সিদ্ধান্ত নাটকীয় ছিল। সে সিদ্ধান্ত ঠিক বলেও প্রমাণিত হয়েছিল। বহরমপুরের পাঁচ বারের সাংসদ অধীর চৌধুরীকে হারিয়ে ইউসুফ সাংসদ হয়েছিলেন। যেমন হয়েছিলেন বিনোদন বা ক্রীড়াজগতের আরও অনেকে। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে তাঁরা ‘সফল’ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে। ইউসুফের সঙ্গে এবং ইউসুফের মতোই ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার কীর্তি আজ়াদও গত লোকসভা ভোটে বাংলার একটি আসন থেকে জিতেছেন। তিনি হারিয়েছিলেন দিলীপ ঘোষকে। কীর্তির রাজনীতিতে আগমন ইউফুফের আগে। তিনি এ খেলার ঘাঁতঘোঁত জানেন। তাই কীর্তি তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অদূরে যখন হিংসার আগুন জ্বলছে, তখন নির্ভার বিকেল এবং সুন্দর চা পানের ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করবেন না। তিনি বরং জড়িয়ে পড়তে পারেন সতীর্থের সঙ্গে হোয়াট্সঅ্যাপ বাগ্‌যুদ্ধে। যা কখনও করবেন না স্বভাবশান্ত ইউসুফ। যে কারণে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হবে। আরও একবার এই প্রশ্ন উঠে আসবে যে, খ্যাতনামীরা কি দৈনন্দিন রাজনীতির আঙিনায় ‘বহিরাগত’ই থেকে যাবেন?

    খ্যাতনামীদের ভোটে দাঁড় করানোর প্রথম কারণ যদি হয় তাঁদের নাম-যশ এবং খ্যাতিকে ব্যবহার করা, তা হলে অন্য কারণ হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে সামাল দেওয়া। ভোটের আগে টিকিট নিয়ে দলের দুই গোষ্ঠীর লড়াই থামাতে ‘অরাজনীতিক খ্যাতনামী’কে এগিয়ে দেওয়া বহু দিনের রেওয়াজ। তৃতীয়ত, খ্যাতনামীরা দলে থাকলেও তাঁদের সে ভাবে কোনও ‘রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ থাকে না। ফলে তাঁরা দলীয় নেতৃত্বের কাছে সমান্তরাল ক্ষমতার কেন্দ্রও হতে পারেন না। পক্ষান্তরে, অধিকাংশ খ্যাতনামীই ‘রাজনীতিক’ হয়ে উঠতে চান না। অনেকে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। ভারতে যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে থেকে গিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন।

    তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন লাগাতার চার বার তৃণমূলের টিকিটে বীরভূম থেকে জয়ী অভিনেত্রী শতাব্দী রায়। গত ১৬ বছরে ‘অভিনেত্রী-সাংসদ’ থেকে ‘সাংসদ-অভিনেত্রী’ হয়েছেন শতাব্দী। অর্থাৎ, তাঁর রাজনীতির পরিচয় ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর অভিনেত্রী পরিচয়কে। দলের যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে তাঁকে পাওয়া যায়। উৎসবে-অনুষ্ঠানে জনসংযোগে থাকেন। কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও রাখেন। সংসদেও নিয়মিত সক্রিয়। যেমন সক্রিয় ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ দেব। নিজের লোকসভা এলাকায় বছরভর যোগাযোগ রাখেন। মেলা-খেলা-উৎসবে হাজির থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার সুনামও রয়েছে বাংলা ছবির এই সুপারস্টারের।

    এমন নিদর্শন বিজেপিতেও রয়েছে। প্রায় বছর দশেক অভিনয়জগৎ থেকে নিজেকে পুরোপুরি দূরে রেখে সর্ব ক্ষণের রাজনীতিক হিসেবে কাজ করছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। কখনও জিতেছেন, কখনও হেরেছেন। কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে সরেননি। রাজনীতির ময়দানে নেমে তাঁর ওজন বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু দলীয় কর্মীর বাড়িতে গিয়ে বেড়ে-দেওয়া ভাত প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। সাংগঠনিক কাজে জুড়ে থেকেছেন। একই গোত্রে পড়েন অগ্নিমিত্রা পাল। বছর ছয়েকের রাজনৈতিক যাত্রাপথে হার-জিত দেখে নিয়েছেন। কিন্তু হতোদ্যম হননি। দলের কাজে রাজ্যের নানা প্রান্তে নিরন্তর ছুটছেন। রাস্তাঘাটে বিক্ষোভ থেকে বিধানসভায় হইচই, সবেতেই অগ্নিমিত্রা আছেন। যেমন আছেন ইন্দ্রনীল সেন এবং বাবুল সুপ্রিয়। দু’জনেই মন্ত্রী। সায়নী ঘোষ প্রথম বারের সাংসদ। তিনিও অভিনয়-টভিনয় ভুলে এখন পুরোপুরি রাজনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আছেন ভোজপুরি তারকা রবি কিষণ এবং মনোজ তিওয়ারি। গত বারই প্রথম ভোটে জিতেছেন কঙ্গনা রনৌত। তিনি সাংসদ বা রাজনীতিক হিসেবে কতটা সক্রিয় থাকেন, সেটা দেখার। শত্রুঘ্ন সিন্‌হা এখনও আসানসোলের সাংসদ। তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রীও থেকেছেন। পুরোদস্তুর ‘রাজনীতিক’ হয়ে উঠতে পেরেছেন আজহারউদ্দিন, নভজ্যোৎ সিংহ সিধু, রাজ বব্বরেরা।

    কিন্তু উল্টো দিকের পাল্লা ভারী। ইউসুফের মতোই রাজনীতির দৈনন্দিনতায় দেখা মেলেনি মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, পিসি সরকার (জুনিয়র), নিমু ভৌমিক, মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়িদের। অনেকে ভোটে জিতেছেন। কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে ‘ছাপ’ ফেলতে পারেননি। আবার অনেকে ভোটে হেরে আর রাজনীতিমুখো হননি। ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহানেরা। মিমি নিজেই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নুসরতকে আর টিকিট দেয়নি তৃণমূল। সর্বভারতীয় স্তরে হেমা মালিনী, সানি দেওল, গোবিন্দ, হংসরাজ হংসের মতো সাংসদদেরও তাঁদের নির্বাচনী এলাকার আমজনতার সঙ্গে দূরত্বই থেকে গিয়েছে।

    ইউসুফ প্রাক্তন ক্রিকেটার। তৃণমূলে তাঁর মতোই ছিলেন এবং আছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্ল এবং মনোজ তিওয়ারি। লক্ষ্মীরতন একটি মেয়াদের পর আর রাজনীতিতে থাকতে আগ্রহ দেখাননি। মনোজ মন্ত্রী হয়েও কার্যত ‘নিখোঁজ’। হুইপ জারি করেও তাঁকে বিধানসভায় হাজির করানো যায় না। তবে বিজেপির ক্রিকেটার-বিধায়ক অশোক দিন্দা তুলনায় সক্রিয়। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র ময়নায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। দলীয় কর্মসূচিতে নিয়মিত থাকেন। বিধানসভাতেও নিয়মিত উপস্থিতি আছে তাঁর।

    মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক গোলমালের আবহে ইউসুফকে নিয়ে স্বভাবতই খানিকটা ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে তৃণমূলে। তবে সেই বিতর্ক আপাতত আর বাড়তে দিতে চায় না শাসকদল। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ খ্যাতনামী-বিতর্ক নিয়ে বেশি আলোচনাতেই নারাজ। তবে বলছেন, ‘‘ইউসুফকে অকারণে আক্রমণ করা হচ্ছে। ওঁর এলাকায় কোনও গোলমালই হয়নি। হয়েছে কংগ্রেস সাংসদ ইশা খান চৌধুরীর এলাকায়।’’ তবে খ্যাতনামীদের সক্রিয়তার প্রসঙ্গে কুণালও সর্বাগ্রে শতাব্দীর উদাহরণই টানছেন, ‘‘শতাব্দী শুধু জনপ্রতিনিধি নন। তিনি নিজের এলাকায় পুরোদস্তুর নেত্রী হয়ে উঠেছেন। জুন মালিয়া, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভলি মৈত্র দক্ষ হাতে সব সামলাচ্ছেন। দেবও খানিকটা চেষ্টা করেন।’’ কিন্তু তৃণমূলে অতীত-বর্তমান মিলিয়ে খ্যাতনামী জনপ্রতিনিধিদের যে লম্বা তালিকা, সেখান থেকে আর কাউকে কুণালও তেমন ‘দরাজ শংসাপত্র’ দিতে পারছেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কাজ না করতে পারাটা এক ধরনের রোগ। পুরোদস্তুর রাজনীতির লোকও রয়েছেন, যিনি জেতার পর আর এলাকায় ঘোরেন না, যোগাযোগও রাখেন না।’’

    রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ রাখঢাকহীন, ‘‘এঁরা রাজনীতি করতে আসেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করতে আসেন। তাই মানুষের চাহিদা বা সমস্যা নিয়ে এঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই।’’ দিলীপের কটাক্ষ, ‘‘আমাদের দলের বিধায়করা বগটুই যাওয়ার পথে শক্তিগড়ে ল্যাংচা খেয়েছিলেন। তৃণমূলের কাছে সেটা বিরাট খবর হয়ে গেল! আর মুর্শিদাবাদের এই পরিস্থিতির মধ্যে সেই জেলার সাংসদ শান্তিতে চা খাওয়ার ছবি পোস্ট করছেন। কোনও সাংসদ মাছ-ভাতের ছবি (ডেরেক ও’ব্রায়েন) পোস্ট করছেন।’’ দিলীপের ব্যাখ্যা, ‘‘রাজনীতি করতে হলে ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রমের মানসিকতা থাকতে হয়। সাংসারিক জীবন, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বাদ দিতে হয়। বাইরের জগৎ থেকে যাঁরা ভোটে লড়তে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই সেই মানসিকতা নিয়ে আসেন না।’’ ঘটনাচক্রে, দিলীপের ব্যাখ্যার সঙ্গে মিলছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘রাজনীতির প্রথম কথা মূল্যবোধ। সেই মূল্যবোধ তরুণ বয়স থেকে ভিতরে তৈরি হয়। মানুষের সঙ্গে থাকা, মানুষের মন বোঝার চেষ্টা করা, দুঃখ-কষ্ট-বেদনা বা ঝড়ঝাপটা সহ্য করার ক্ষমতা দরকার হয়। খ্যাতনামীদের সেটা থাকে না।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)