• ‘মাকে মেডেল পরানো স্বপ্নের মতো’, প্রিয় ক্লাবকে ট্রফি জিতিয়ে অকপট মোহনবাগানের ‘নয়নমণি’ দীপেন্দু
    প্রতিদিন | ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • বোরিয়া মজুমদার: একটা স্বপ্নকে বুকের মধ্যে আদরে-ভালোবাসায় বড় করে তোলা। বহু পরিশ্রম, সংগ্রামের পথ পার করে গলায় চ্যাম্পিয়নের মেডেল। কষ্ট ছিল, ব্যর্থতার ভয় বারবার দরজায় কড়া নেড়েছে। আর তখন কাঁধে যিনি ভরসার হাত রেখেছেন, বারবার বলেছেন যে, পারতেই হবে। তিনিই তো মা। আইএসএল কাপ জয়ের পর সেই মায়ের গলায় চ্যাম্পিয়নের মেডেল তুলে দিলেন মোহনবাগানের নয়নমণি দীপেন্দু বিশ্বাস। জীবনের যাবতীয় অর্জনকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার মতো আনন্দের মুহূর্ত কি আর কিছু হতে পারে! দীপেন্দুর মায়ের মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। আর যে ক্লাবকে ছোটবেলা থেকে সমর্থন করে এসেছেন, যার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে প্রস্তুত, সেই মোহনবাগানের জার্সিতে দ্বিমুকুট জয়। আসল ‘চ্যাম্পিয়ন’ তো দীপেন্দুই। উঠতি প্রতিভা থেকে দ্বিমুকুট জয়, সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুললেন দীপেন্দু বিশ্বাস।

    আজকের যুগে তো কত কিছুই ‘ভাইরাল’ হয়। তার মধ্যে থেকে সোনার ফ্রেমে বাঁধানোর মতো মুহূর্ত তৈরি হল আইএসএল কাপ ফাইনালের পর। যুবভারতীর সবুজ-মেরুন রঙে রাঙানো মায়াবী রাতে দীপেন্দু বিশ্বাস তাঁর মায়ের গলায় চ্যাম্পিয়নের মেডেল পরিয়ে দিলেন। পাশে ছিলেন তাঁর বাবাও। ঠিক কেমন ছিল সেই মুহূর্তের অনুভূতি? দীপেন্দু বলছেন, “খুবই ভালো লাগছে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আর এরকম একটা সময়ে মা-বাবাকে পাশে পাওয়ার মতো গর্ব আর কী হতে পারে? মায়ের গলায় মেডেলটা তুলে দিতে পারা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। এটা ভেবে আরও ভালো লাগছে যে আইএসএল কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মায়ের গলায় মেডেল তুলে দিতে পেরেছি।”

    আর যাদের জন্য এত পরিশ্রম, এত লড়াই, তাঁরা কী বলছেন? দীপেন্দু জানালেন, “মা-বাবাও খুশি। আমি আসলে ভাবিনি স্বপ্নটা এভাবে পূরণ হবে। তবে একটা স্বপ্ন বহুদিন ধরেই ছিল। যদি জীবনে কিছু অর্জন করতে পারি, সেটা মা-বাবার হাতেই তুলে দেব। আমার সাফল্যের আসল কৃতিত্ব তো তাঁদেরই। লিগ শিল্ডের পর আইএসএল কাপ চ্যাম্পিয়ন হলাম। এই সাফল্য মা-বাবাকেই উৎসর্গ করছি।”

    অথচ বছর পাঁচেক আগেও জানতেন না, এরকম স্বপ্নের রাত তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। করোনার সময় খুব কঠিন পরিস্থিতর সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একটা সময় তো মনে হয়েছিল, এবার বুঝি ফুটবল ময়দান ছাড়তে হবে। কিন্তু লড়াইয়ের মঞ্চ তিনি ছাড়েননি। মাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন। নিজেকে যেন বলতেন, ‘ফাইট, দীপেন্দু ফাইট’। সেই সমস্ত পরিশ্রমের প্রথম সাফল্য মোহনবাগানে সুযোগ পাওয়া। তারপর প্রথম দলে ডাক। নিয়মিত দুর্দান্ত পারফর্ম করা। এক সময় কথা হত, তিনি আনোয়ার আলির বিকল্প হতে পারবেন কি না? না, দীপেন্দু কারওর বিকল্প নন। দীপেন্দু, দীপেন্দুই। এখন মোহনবাগানের ‘ঘরের ছেলে’। ২১ বছর বয়সি ডিফেন্ডার বলছেন, “প্রথম দিকে একটু চাপ ছিল। এত বড় দলে প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়েছি। আসলে আমি আগে মোহনবাগান-ভক্ত, তারপর মোহনবাগানের ফুটবলার। তাই ট্রফি জিততে পারা আমার কাছে বাড়তি আনন্দের।”

    আর সেই জন্যই হয়তো তাঁর কাছে ডার্বি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আইএসএলে বড় ম্যাচের সব সাফল্যই মোহনবাগানের ঝুলিতে। দীপেন্দুর বক্তব্য, “ফাইনালের থেকেও ডার্বি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সমর্থকদের আবেগ জড়িয়ে থাকে ম্যাচটায়। কত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকিয়ে থাকে এই ম্যাচের দিকে। ম্যাচের আগে-পরে সমর্থকরা উৎসাহ যোগান। সেটাই তো এই ম্যাচের আসল আকর্ষণ।” সেই যুদ্ধ তো বহুবার জয় করেছে মোহনবাগান। আইএসএলের দ্বিমুকুট জয়ও সম্পূর্ণ। দীপেন্দু তার কৃতিত্ব দিচ্ছেন সমর্থকদের। মোহনবাগানের নতুন ‘হিরো’ বলছেন, “আমরা যে ট্রফি জিতলাম তার ৫০ শতাংশের বেশি কৃতিত্ব সমর্থকদের। তারা মাঠে না এলে, আমরা এই জায়গায় আসতে পারতাম না। ফলাফল যাই হোক না, তারা সব সময় দলের পাশে ছিল। তাদের শুধু বলব, এভাবে সমর্থন করতে থাকলে ভবিষ্যতে আমরা আরও সাফল্য পাব।”

    এ তো গেল দলের কথা। আর ব্যক্তিগত সাফল্য? পাখির চোখ ঠিক করে ফেলেছেন তিনি। আপাতত লক্ষ্য সুপার কাপ জিতে ত্রিমুকুট জয়। তারপরের লক্ষ্য জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া। তার জন্য কী করতে হবে সেটাও বুঝে নিয়েছেন দীপেন্দু। সাফল্যের একটাই মন্ত্র- পরিশ্রম। মোহনবাগানের আরেক বাঙালি ডিফেন্ডার শুভাশিস ক্রমাগত সাহস যোগান। “সামনের দিকে তাকাও। জাতীয় দলে খেলতে হবে। কী করলে উন্নতি হবে সেটা দাদা ধরে ধরে বুঝিয়ে দেন”, এক নিঃশ্বাসে বলে যান দীপেন্দু। এর সঙ্গে টম অলড্রেড, আলবার্তো রদ্রিগেজদের পরামর্শ। ব্যক্তিগত উত্থানের জন্য দীপেন্দু কৃতিত্ব দিচ্ছেন মোহনবাগান ড্রেসিংরুমের খোলামেলা পরিবেশকে। সেখানে সবাই সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে, পাশে থাকে। ভুলত্রুটি হলে ঠিক করে দেয়। এটাই যে সবুজ-মেরুনের সাফল্যের মূল ভিত্তি, সেটা দরাজ কণ্ঠে স্বীকার করেন দীপেন্দু। তিনি ধন্যবাদ জানান, সুপার জায়ান্টসের চেয়ারম্যান সঞ্জীব গোয়েঙ্কা থেকে দলের সার্বিক ম্যানেজমেন্টকে।

    আর একজনকে বাদ দিলে যে এই কৃতজ্ঞতার তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি মোহনবাগানের কোচ জোসে মোলিনা। কোথায় স্পেশাল তিনি? কোথায় অন্য কোচেদের থেকে আলাদা? দীপেন্দু বলেন, “কখন কোন প্লেয়ারকে বদলাতে হবে, সেটা তিনি খুব ভালোমতো জানেন। স্যরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাকে এত সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমাদের মতো তরুণ ফুটবলারদের সাহায্য করছেন। ওঁর সঙ্গে খোলামনে আলোচনা করা যায়, কথা বলা যায়। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন।” আরও একটা কারণে হয়তো মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে মোলিনা ‘স্পেশাল’। দীপেন্দুর মতো একজনকে পলকাটা হিরের মতো তৈরি করার জন্য। যিনি দ্যুতি ছড়াবেন, আরও বহু বহু দিন।
  • Link to this news (প্রতিদিন)