সংবাদদাতা, কাটোয়া: তীব্র গরম, তাপপ্রবাহ বাড়ছে। হাঁসফাস করছে গোটা দক্ষিণবঙ্গ। গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে দেদার বিক্রি হচ্ছে তালপাতার পাখাও। কাটোয়ার শ্রীখণ্ডের বাগটোনা গ্রামে তালপাতার পাখাশিল্প এখনও টিকিয়ে রেখেছেন শিল্পীরা। তাঁদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে লুপ্তপ্রায় শিল্প বাঁচিয়ে রাখলেও সরকারিভাবে শিল্পীর স্বীকৃতি মিলছে না। অবিলম্বে শিল্পীদের সম্মান দেওয়া হোক।
কাটোয়ার-১ ব্লকের শ্রীখণ্ড পঞ্চায়েতের বাগটোনা গ্রামের থাণ্ডারপাড়ার ৪০টি পরিবারে প্রায় ২০০জন বাসিন্দা বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তালপাতার পাখা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে। গ্রীষ্মকালে এখনও বাংলার গ্রামে তালপাতার পাখার চাহিদা তুঙ্গে। শুধু তাই নয়, এখনও রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে পুরনো দিনের তালপাতার টকুই, ঝুড়ি প্রভৃতি সামগ্রীর চাহিদা বিপুল। কাটোয়ার বাগটোনা গ্রামের বহু মানুষ তালপাতার পাখা, টকুই তৈরি করেই সংসার চালান।
ফাল্গুন-চৈত্র মাস আসতেই বাগটোনা গ্রামে ঘরে ঘরে তালপাতার পাখা বুনতেই ব্যস্ত থাকেন বাড়ির পুরুষ থেকে মহিলারাও। সংসার সামলে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও বসে বসে পাখা তৈরি করে সংসার চালান। চৈত্র মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত কাটোয়া, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, ভাতার, বলগোনা, বর্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি এলাকার বাজারগুলিতে পাখা বিক্রি করেন এই গ্রামের শিল্পীরা। এবার তীব্র গরমে তালপাতার চাহিদাও বাড়ছে। ভালো বিক্রিতে শিল্পীদের মুখে হাসি ফুটেছে। তবে তাঁদের দাবি, শিল্পী পরিচয়পত্র দিলে ভালো হয়। অন্তত শিল্পটাকে বাঁচানো যাবে।
বাগটোনা গ্রামের বাসিন্দা অপর্ণা থাণ্ডার, সন্তোষী থাণ্ডার, ধর্মদাস থাণ্ডার বলেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে পাখা বুনে বাড়িতেই মজুত রাখি। আর চৈত্র মাস আসতেই বাজারে বিক্রি করি। এবার ভালো গরম পড়েছে। এখনও তালপাতার পাখার চাহিদা বাড়ছে। এবার গরম পড়তেই বাজারে জোগান দিতে পারছি না। তবে আমরা ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাই না। গ্রীষ্মকালেই তো আমাদের বিক্রি বাড়ে। এখন তালপাতা গাছ থেকে পেড়ে দেওয়া ও তালপাতার দাম নিয়ে একটা তালগাছ পিছু ১০০টাকা দিতে হয়। আর এক-একটা পাখা বিক্রি করে মাত্র ১০টাকা পাওয়া যায়। এতে কী সংসার চলে? প্রশাসন আমাদের শিল্পীর সন্মান টুকু দিলে ভালো হয়। বাগটোনা, শ্রীখণ্ড প্রভৃতি বিভিন্ন গ্রামের সার দিয়ে রয়েছে প্রচুর তালগাছ। এইসব তালগাছ থেকে তালপাতা পেড়ে নিয়ে এসে রোদে শুকানো হয়। তারপর সেগুলি বুনে বাহারি রং দিয়ে হাতে ঘোরানো তালপাতা তৈরি হয়। তাছাড়া গ্রামে গৃহস্থের ব্যবহার করা টকুই, ঝুড়ি প্রভৃতি তৈরি হয়। তারপর সেগুলি বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন বৈদ্যুতিক পাখা, এসির মেশিনের চাহিদা বাড়লেও গ্রামাঞ্চলে এখনও তালপাতার পাখার কদর রয়েছে। শিল্পী উদ্ধারণী থান্ডার, ছবি থাণ্ডার বলেন, একটা গাছ থেকে প্রায় ৫০টি পাখা তৈরি করা যায়। সারাদিনে ৪০-৪৫টা পাখা তৈরি করে ২০০-৩০০টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বাজারে পাইকারি দরে এক-একটা পাখা ৭-৯টাকা আর খুচরো ১০-১২টাকায় বিক্রি করা হয়। তাছাড়া জামাইষষ্ঠী, পুজোতে তালপাতার পাখা, টকুই প্রভৃতি দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজোর জন্য চাহিদা বেশি থাকে।
রাজ্যে এখন গ্রামীণ তালপাতার পাখা শিল্প অনেক কমে গিয়েছে। কোনও কোনও গ্রামে তৈরি হলেও কাটোয়ার মতো গোটাগ্রাম জুড়ে আর এই শিল্প প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ একসময় মাটির বাড়িতে গ্রীষ্মের দুপুরে মা-ঠাকুমার কোলে শুয়ে হাতপাখা ঘোরানোর রেওয়াজ ছিল।