মহম্মদ মহসিন, উলুবেড়িয়া
উলুবেড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্রের এক প্রান্তে শান্ত সবুজে ঘেরা গ্রাম বেলাড়ি। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে হুগলি নদী। তার ধার বরাবর কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় হোটেল, রিসর্ট ও বিলাসবহুল বাংলো। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে বহু মানুষ ভিড় করেন এই জায়গায়।
বিশেষ করে শীতকালে এবং বর্ষার সময় পর্যটকদের আনাগোনা খুব বেড়ে যায়। সেজন্য অনেকে এই এলাকাকে ‘মিনি মন্দারমনি’ বলে ডাকেন। মন্দারমনিতে কোস্টাল আইন ভেঙে সমুদ্র উপকূলে বেআইনি ভাবে অনেক হোটেল, রিসর্ট তৈরি হয়েছে। একই ভাবে বেলাড়িতেও নদীর চর দখলের অভিযোগ উঠছে হোটেল ও রিসর্ট মালিকদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেলাড়ি এলাকায় হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে যে সব হোটেল ও রিসর্ট তৈরি হয়েছে, তাদের অনেকেই চর দখল করে বাণিজ্যিক কাজে ভাড়া দিচ্ছে। নদীর চরে প্যান্ডেল বেঁধে বিয়েবাড়ি, জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে। নদীর চর ভাড়া দিয়ে হোটেল ও রিসর্ট মলিকরা লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করলেও সরকারি কোষাগারে একটি পয়সাও জমা পড়ছে না। একই ভাবে শ্যামপুর থানার গড়চুমুক পর্যটন কেন্দ্রের কাছে দামোদর নদীর পাড় দখল করে সুইমিং পুল তৈরির অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় একটি রিসর্ট মালিকের বিরুদ্ধে। তা নিয়ে অভিযোগ দায়ের হলেও বেআইনি নির্মাণ এখনও ভাঙা পড়েনি।
বেলাড়ি এলাকায় নদীর চর দখলের অভিযোগ নিয়ে দায় এড়াচ্ছেন শাসক দলের নেতারা। তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি সদানন্দ রায়চৌধুরীর দাবি, এখানে যাবতীয় বেআইনি নির্মাণ হয়েছে বাম আমলে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে কাউকে নদীর চরে নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
হাওড়া জেলার একেবারে শেষ সীমানায় অবস্থিত শ্যামপুর ইট শিল্পের জন্য বরাবরই বিখ্যাত। ভৌগলিক ভাবে শ্যামপুর একটি নদী বেষ্টিত এলাকা। পশ্চিম দিকে রয়েছে হুগলি নদী, উত্তরে রূপনারায়ণ এবং দক্ষিণে দামোদর। তার মধ্যে সব থেকে বেশি ইটভাটা রয়েছে হুগলি এবং রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে। শ্যামপুরের শিবগঞ্জ, গাদিয়াড়া, গড়চুমুক প্রভৃতি এলাকায় এই ধরনের ইটভাটা দেখতে পাওয়া যায়। সেই ইট শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি।
অভিযোগ, ইট তৈরির জন্য ভাটা মালিকরা নদী থেকে ইচ্ছা মতো পলিমাটি তুলে নিচ্ছেন। জোয়ারের সময় নদীতে পলি পড়ে। নদীতে যখন ভাটা পড়ে তখন সেই পলি মাটি তুলে নিচ্ছে ইটভাটা মালিকরা। অনেক ভাটা মালিক আবার শক্তিশালী পাম্প মেশিন বসিয়ে নদী থেকে পলি তুলে নিচ্ছেন। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর বাঁধ। সেই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে নদীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যও। পরিবেশকর্মী শুভ্রদীপ ঘোষ বলেন, ‘নদী থেকে পলি তোলা এবং নদীর পাড়ে কাঠামো নির্মাণ, দু’টোই প্রকৃতির পক্ষে বিপজ্জনক। এটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সজাগ থাকা উচিত।’
শ্যামপুর থানার ব্রিক ফিল্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক তন্ময় শী’র অবশ্য দাবি, ইট তৈরির জন্য তাঁরা যে মাটি ব্যবহার করে থাকেন তার জন্য ভাটা মালিকরা সরকারকে মোটা টাকা রয়্যালটি দেয়। নদীর পলি তোলার বিষয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মেনে চলার জন্য তাঁরা মালিকদের সচেতন করছেন। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন, প্রশাসন থেকে নিষেধ করে দেওয়ায় অনেক জায়গায় রাতের অন্ধকারে নদী থেকে পলি তোলা হচ্ছে। তার জেরে শ্যামপুরে ভাঙন দেখা দিচ্ছে।
শ্যামপুর থানার পূর্ব বাসুদেবপুর এলাকায় বছর দু’য়েক আগে নদী ভাঙন শুরু হয়েছিল। অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁধ নদীগর্ভে চলে গিয়েছিল। তার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা সেই সময় জানিয়েছিলেন, হুগলি নদী থেকে যথেচ্ছ ভাবে পলি তোলার কারণেই এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জিও পলিকার্বনেট শিট দিয়ে বাঁধ মেরামত করা হয়েছে।
বেলাড়ি, কোলিয়া, গাদিয়াড়া–সহ শ্যামপুর থানার বিভিন্ন এলাকায় নদীর পাশে গজিয়ে উঠেছে একাধিক জাহাজ কারখানা। সেখানে মূলত ট্রলার ও লঞ্চ মেরামত করা হয়। তার জন্য ইট দিয়ে নদীর ধারে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। অধিকাংশ কারখানারই কোনও অনুমোদন নেই।