রাখি গুলজ়ার, না কি রাখি মজুমদার? ছবি করতে গিয়ে দেখলাম, পদবি যা-ই হোক, কিংবা বাড়ির ঠিকানা— রাখিদি আদ্যন্ত বাঙালি। আজও। আমার কথার পিছনে অসংখ্য যুক্তি আছে। যেমন ধরুন, এখনও ওঁর বাংলা ছবির প্রতি আগ্রহ। রাখিদির সঙ্গে কথা বলার আগে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, রাখি গুলজ়ার নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি দেখেন! ‘হামি’ ওঁর অন্যতম পছন্দের ছবি। ফোন করতেই একই কথা রাখিদিও বলেছিলেন। পরিষ্কার বাংলায়।
সেই ভরসায় ‘আমার বস্’ ছবির চিত্রনাট্য শোনাতে মুম্বই যাই। ফোন করে ঠিকানা জানতে চাইতেই চমকে দিলেন আমায়! “ঠিকানা চাও? বলছি শোনো, আমড়াতলার মোড়ে/তিনমুখো তিন রাস্তা গেছে, তারই একটি ধরে...” গড়গড় করে সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’ কবিতা আউড়ে গেলেন!
আমরা বাঙালিয়ানা নিয়ে অনেক কথা বলি। এখনও চৈত্র সেলে দরদাম করে নতুন পোশাক, ঘর সাজানোর জিনিস কিনি। পয়লা বৈশাখ এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ মনে পড়ে। বাংলা সাল কত জনের মনে থাকে? বলিউডে বসে রাখিদি আমাদের সকলের থেকে বেশি বাঙালি। ওঁর পোশাকে, কথা বলার ভঙ্গিতে, খাওয়া দাওয়ায়, ভাবনায়, পুজো-অর্চনায়— শুধুই বাঙালিয়ানা।
প্রথম যে দিন দেখা করতে যাব, সে দিন আমাদের থালায় ফিশফ্রাই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। উনি জানেন, মাছেভাতে বাঙালি। যতই অভিনয় পেশা হোক, শরীর সচেতন হই— ফিশফ্রাই এড়াতে পারব না! এই যে বাঙালির ‘পাল্স’ বুঝতে পারা— এটাই তো আজকের দিনে দুর্লভ। তিনি নিজেও মাছ-ভাত ছাড়া খান না। খাওয়াদাওয়ার কথা বলতেই একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। ওঁর কড়া নির্দেশ, বাঙালি খাবার ছাড়া খাবেন না। সেই মতো রান্না হয়েছিল। নন্দিতাদি ওঁকে নিজের হাতে পরিবেশন করেছিলেন। খেতে খেতে মুখেচোখে তৃপ্তির এক অদ্ভুত আলো খেলা করছিল। রাখিদির খুশিমুখ দেখে আমরা স্বস্তিতে। অন্য দিকে, ফুচকা দেখে কিশোরীর মতোই ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস! শুটিং থামিয়ে সকলকে নিয়ে একের পর এক ফুচকা খেয়েই যাচ্ছেন! শেষে ফুচকাওয়ালাকে ইশারা করে ওঁকে থামাতে হয়েছিল।
শাড়ি বাছা নিয়ে কোনও কথাই নেই। বাকি বাঙালি মেয়েদের মতোই শাড়ি নিয়ে প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে। নিজের শাড়ি ছাড়া পরবেনই না। ‘আমার বস্’-এর জন্য পোশাক পরিকল্পক অভিষেক রায়কে মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার আগে নিজেই একপ্রস্ত শাড়ি বেছে রেখেছেন। অভিষেককে নিজের আলমারি খুলে দিয়ে বলেছিলেন, “দ্যাখো, এর থেকে কোনগুলো তোমাদের পছন্দ হয়।” অভিষেকের পছন্দের পর সেই শাড়ি আমাদেরও দেখতে হয়েছে। তবে দিদি খুশি। এই খুঁতখুঁতামির কারণেই, হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সময় নিজের পোশাক নিজেই বাছতেন। অন্যের পোশাক বা শাড়ি ভুলেও কোনও দিন পরেননি।
শুটিং করতে এসে পুরো টিমের ‘দিদি’ হয়ে ওঠা— বাঙালির আন্তরিকতার আর এক পরিচয়। ওঁর এক ভাই ছিল, নাম শিবু। ছিল, কারণ তিনি আর নেই। আমার শিবপ্রসাদ নাম সকলের মুখে মুখে ‘শিবু’ হয়ে গিয়েছে। শুনেই চমকে উঠেছিলেন। তার পর থেকে আমি ওঁর ভাই। শাসনে, সোহাগে, আদরে, বকুনিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের দিদির মতো। সরস্বতী পুজোর শুটিং হচ্ছে। ভুল করে জুতো পায়ে চলে গিয়েছি। শুটিং থামিয়ে দিয়ে কড়া ধমক! পরে তিনিই গায়ে হাত বুলিয়ে নিজের হাতে রাঁধা খাবার বসিয়ে খাইয়েছেন। এখনও তাঁর রাঁধা খিচুড়ি, লাবড়া, ভাজা, চাটনির স্বাদ জিভে লেগে আছে।
এটাই রাখি মজুমদার... কিংবা রাখি গুলজ়ার। বাংলায় থেকেও আমরা ওঁর মতো করে বাঙালিয়ানাকে নিজেদের রক্তে মিশিয়ে নিতে পারিনি।