• নিঃসঙ্গ নববর্ষে লক্ষ্মীদের প্রশ্ন, যন্ত্রণার শেষ কোথায়
    এই সময় | ১৫ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: গত বছর বাংলা নববর্ষের - দিনটা কেমন ছিল আপনাদের কাছে? প্রশ্ন শুনে মুখগুলো তাকিয়ে থাকে। নিশ্চুপ, নিশ্চল। চোখ জুড়ে একরাশ শূন্যতা। হয়তো বুকফাটা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। প্রচণ্ড ক্রোধ, ক্ষোভে সমস্তকিছু লন্ডভন্ড করে দেওয়ার ইচ্ছাও হয়তো প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁরা নীরব। স্তব্ধতাই একমাত্র হাতিয়ার! ধরা যাক লক্ষ্মীশ্রী কুন্ডুর কথা। উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্নাতক স্তরে সেকেন্ড ক্লাস, পরে সংস্কৃতে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া এই শিক্ষিকা পড়াতেন পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুর আছড়া রায় বলরাম হাই স্কুলে। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াতেন সংস্কৃত। স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে আরাধ্যা থাকেন বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে। সুপ্রিম নির্দেশে শ্রী হারিয়েছেন লক্ষ্মী। স্বামীর স্থায়ী চাকরি নেই। নববর্ষ শব্দটাই এক লহমায় তাঁর কাছে অজানা, অচেনা হয়ে গিয়েছে।

    'নববর্ষ?' নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসেন লক্ষ্মীশ্রী। বলতে থাকেন, 'প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। কীসের নববর্ষ? কার নববর্ষ? চারপাশে শুধুই তো অমঙ্গলের ছায়াই চোখে পড়ে।' একটু থেমে ফের বলে ওঠেন, 'গত বছর বা তার আগেও এই সময়ে ছুটি থাকায় কয়েকদিনের জন্য রূপনারায়ণপুর থেকে বাড়িতে ফিরতাম। মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে স্থানীয় মন্দিরে পুজো দিতাম। কাছাকাছি কোনও জায়গায় দু-একদিনের জন্য ঘুরতেও গিয়েছি। মেয়ের জন্য নতুন পোশাক কিনতাম। এ বার কী করব।'

    অন্যদের মতো অনেক কষ্ট স্বীকার করেই লক্ষ্মীশ্রী নিজেকে এই উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এখন পুরোটাই অলীক বলে মনে হয়। বলে চলেন, 'হয়তো পাড়ার মন্দিরে পুজো দেবো, কিন্তু মন কি সঙ্গ দেবে? ঘরে টাকার অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। মেয়ের পড়াশোনায় তো ছেদ টানতে পারব না। নিজেও তাক থেকে নামিয়েছি পুরোনো বইপত্র। সময় নষ্ট না-করে আবার নিজের যোগ্যতা যাচাইয়ের অগ্নিপরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি।' যোগ করেন, 'শুধুমাত্র আশ্বাসে কিছুই এসে যায় না আইনের। সে চায় প্রমাণ, উপযুক্ত তথ্য। সরকারকেই ঠিক করতে হবে, তারা কী করতে চায়।'

    বাঁকুড়ার ওন্দার পাত্রহাটি রামরতন উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা দুয়ারির কাছেও নববর্ষ অর্থহীন। মাথায় যখন আকাশ ভেঙে পড়ে, তখন কি আর রামধনুর দিকে তাকিয়ে থাকা যায়? বলছিলেন, 'এত বড় একটা বিপর্যয়ের পরে আনন্দ করার মতো মানসিক পরিস্থিতি নেই। নতুন বছর শুধুই একটা বিবর্ণ দিন। আমাদের বেশ কিছু শিক্ষক এখনও কলকাতার রাস্তায় বসে রাত জাগছেন। প্রতিবাদ-আন্দোলনেই থাকব।' বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক শিশিরকুমার গড়াই বলেন, 'যারা সব হারিয়েছে, তাদের আবার কীসের নববর্ষ! এই দিন দেখার জন্য তো এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছিলাম। নিজেকেই এখন বার বার করে এই প্রশ্নটাই করি। নববর্ষের কোনও মুল্য নেই।'

    পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক কৈলাস বাউড়ি ৩ এপ্রিল থেকে চাকরিহারা। বললেন, 'কীসের গাজন আর কীসেরই বা পয়লা বৈশাখ। এ সময়ে জেলায় নানা প্রান্তে গাজন হয়। পরিচিতরা ফোন করত, এ বার কেউ ফোন করেনি। হয়তো ওরাও দ্বিধায় রয়েছে!' স্বগতোক্তি করেন, 'কত দোকান নিমন্ত্রণ করত হালখাতায়। এখন কিছুই আর বিশ্বাস হয় না।'

    পুরুলিয়ার লাগদার আর এক চাকরিহারা শিক্ষক চিত্তরঞ্জন মাহাতোর কথায়, 'অন্ধকারে উদভ্রান্তের মতো পথ হাতড়ে চলেছি। জানি না, এর শেষ কোথায়! যেদিন যোগ্য হিসেবে আবার শিক্ষকতায় ফিরতে পারব, সেটাই হবে আমাদের সকলের আসল নববর্ষ।' যোগ্য-অযোগ্য নিক্তিতে দোদুল্যমান ওঁরা। চলে যায় নববর্ষ। চোখে নেমে আসে অন্ধকার।

  • Link to this news (এই সময়)