সুমনা চক্রবর্তী
‘একলা বৈশাখের প্রীতি ও শুভেচ্ছা’ সকাল থেকে মাইকে ঘোষণা চলছে পাড়ায়। জানা গেল, ঘোষক সম্প্রতি প্রেমে দাগা খেয়েছেন। ফলে শুরু হয়েছে তাঁর বিরহের বেলা। নিট ফল, তামাম পাড়াবাসীর কান ঝালাপালা। সকালের আধঘুম, দুপুরের ভাতঘুম জীবনের সব আয়েশ ফালাফালা! তা কী আর করা! এমন এক একলা থুড়ি, পয়লা বৈশাখে পাড়ার গানের ইস্কুলে অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড!
ভরদুপুরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে নাকি। নইলে ও দিকে, বিকেল গড়াতে না গড়াতেই দোকানে দোকানে হালখাতা করতে যাওয়ার তাড়াহুড়ো পড়ে যাবে যে! লাল পাড় সাদা শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা কচি মুখগুলি এখন আবৃত্তি-নাচ-গানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বটে, কিন্তু ওরাই তখন গুটি গুটি পায়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে নতুন জামা পরে লাড্ডু আর কোল্ড ড্রিংকসের লোভে দোকানগুলির দিকে পা বাড়াবে। গানের দিদিমণি তখন কোথায় পাবেন শিল্পী? কোথায়ই বা পাবেন শ্রোতামগুলী? অতএব দুপুরই সই, ভেবে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। তাপ্পরে, সব পাড়ার ছোটখাটো নাচ-গান-আবৃত্তির স্কুলে যেমন হয় আর কী।
সমস্বরে সবাই মিলে আর্তনাদ, 'এসো হে বৈশাখ! এসো এসো'। শুনে তিরিক্ষে মেজাজের বৈশাখ দিদি গরম আরও দু'ডিগ্রি বাড়িয়ে দেন পারলে। শ্রোতারাও ছানাপোনাদের তাড়নায় অতি কষ্টে ছন্দে ছন্দে তাল দেন বটে, কিন্তু বারবার হাতঘড়ি দেখাটা লুকোতে পারেন না। দু'টো করে গান, একটা নাচের মাঝে এক পিস আবৃত্তি ঢুকিয়ে দেন সঞ্চালিকা। তারও আজ তাড়াহুড়ো। একলা ঘোষকের কথা মনে পড়ে তার মন উচাটন। টাক মাথায় ফুলের মালা হেয়ার ব্যান্ডের মতো করে পরানো পুঁচকে শিল্পী চোখের জলে, নাকের জলে, শরীরের ঘামে একসা ততক্ষণে।
'বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে' বলেই বিলকুল সাফ তার মাথা। খানিক পরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তারস্বরে ভ্যাঁ...। তার হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিয়ে যান মা। নাক কাটা যাওয়ার শোকে তার পরে মুখ ব্যাজার করেই কাটান তিনি। ম্যানেজ দিতে মঞ্চে এ বার তোলা হয় এক টগবগে কিশোরকে। তার 'ওই এল বৈশাখ,
ওই নামে গ্রীষ্ম, খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব!' শেষ হতে না হতেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে নাচের দল। সঞ্চালিকা ঘোষণা করেন, এ বার আপনাদের সামনে 'দারুণ অগ্নিবাণে রে' পেশ করবে অঙ্কিতা, মিঠি, শ্বেতা, শুভ্রা, ডলি, মহুয়া। তালি পড়ে মুহুর্মুহু। দিদিমণি ইশারা করেন গান চালানোর। কিন্তু কে যেন ভুল করে চালিয়ে দেয়, 'শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন, আমলকির ওই ডালে ডালে।'
খুদেগুলো অবশ্য বেশ স্মার্ট। শীতের হাওয়ায় দারুণ অগ্নিবাণের অঙ্গভঙ্গি করেই সামাল দেয় স্টেজে। শুধু দর্শকমহলে গুঞ্জন ওঠে, আরে শীতের গান কেন বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে? সমালোচনা অবশ্য খুব বেশি জমতে পারে না। তার আগেই সমাপ্তি সঙ্গীত বেজে ওঠে, 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর'। অনুষ্ঠান কোনও রকমে শেষ করেই সবাই পা চালায় জোরে। পরিচিত দোকানগুলিতে ছুঁ মারতে হবে। প্যাকেট শেষ হয়ে যায় যদি! হালখাতা! পুরোনো খাতা বন্ধ হয়ে নতুন খাতা চালু হওয়া। নতুন হিসাব-কিতাব। খানিক টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে আসা। নতুন ক্যালেন্ডারও চাই। অভ্যেস বশত, দেওয়ালের এক কোণে ঝোলানো থাকবে সারা বছর। ধুলো জমবে। দেওয়ালে দাগ ধরবে। শুধু পুজোপালি আর বচ্ছরকার দিনগুলোতে লোকের নজর যাবে তার দিকে। তবুও থাকবে তো... ওটুকুই শান্তি একলা ক্যালেন্ডারের!