• দু’টি ‘ময়ূরপঙ্খী’ নিয়ে রানাঘাটে আজও অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছে নববর্ষের ‘গোষ্ঠবিহার যাত্রা’
    বর্তমান | ১৬ এপ্রিল ২০২৫
  • দীপন ঘোষাল, রানাঘাট : আজকের আধুনিকতায় পাশ্চাত্যের প্রবল প্রভাব। তাই ‘নিউ ইয়ার ইভ’-এর ঝলকানিতে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন। তবে শুধু পাশ্চাত্য কেন, রাজনীতির ঠেলায় বঙ্গের সংস্কৃতিতে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সংস্কৃতি। এমতাবস্থায় বাংলার আঞ্চলিক সংস্কৃতিগুলির বড়ই রুগ্ন দশা। ঠিক যেমন রানাঘাটের নিজস্ব বৈশাখী উৎসব ‘গোষ্ঠবিহার যাত্রা’। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে শহরের রাস্তায় চেনা ‘ময়ূরপঙ্খী’ নামলেও, তা সংখ্যায় মোটে দু’টি। রানাঘাটের একান্তই আপন এই উৎসব কতটা ক্ষয়িষ্ণু, এর থেকে তা সহজেই অনুমেয়। গোষ্ঠবিহারের আগামী ভবিষ্যৎ কী? প্রথা-সামাজিকতা মেশানো সন্ধ্যা উস্কে দিল এই প্রশ্নও।

    গোষ্ঠবিহার যাত্রার ইতিহাস প্রায় দুই শতাধিক বছরের প্রাচীন। ঐতিহাসিকরা বলেন, তৎকালীন রানাঘাটের জমিদার পালচৌধুরীরা ঘোষেদের নিয়ে এসে বিভিন্ন বসতি স্থাপন করান। মূলত এই ঘোষেরা ছিলেন তাঁদের লাঠিয়াল। পেশাগত দিক থেকে তাঁরা গোপালকও বটে। বাংলা বছরের সংক্রান্তি এবং নববর্ষের দিনে তাঁরা গৃহপালিত গোরুগুলিকে বিশ্রাম দিতেন। স্নান করিয়ে, শিং ও কপালে সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে, পশুদের খাওয়ানো হতো ভালো-মন্দ খাবার। রাত নামলে বলিষ্ঠ গোরুগুলিকে সাজিয়ে দৌড় করানো হতো। পরে যা ধীরে ধীরে শোভাযাত্রায় পরিণত হয়। প্রথম পর্বে নাম না থাকলেও, পরবর্তীতে এই বিশেষ শোভাযাত্রা ‘গোষ্ঠবিহার যাত্রা’ নামে পরিচিত হয়। মূলত, সারি সারি গোরুর গাড়ি সাজিয়ে তোলা হতো। ময়ূরপঙ্খীর মতো দেখতে হওয়ার কারণে আজও গাড়িগুলি স্থানীয়ভাবে ‘ময়ূরপঙ্খী’ বলেই পরিচিত। গোরুর গাড়িতে বাঁধা হতো গ্যাসবাতি। আর সঙ্গে কবিগান। অর্থাৎ, বর্তমানের সঙ্গে প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মিশেল সেযুগ থেকে এযুগেও দেখা গিয়েছে। একসময় মাটির পুতুলের সাহায্যে সতীদাহ, বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলি নিয়ে প্রচার চলত এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে। মঙ্গলবার বর্ষবরণের সন্ধ্যায়ও স্থানীয় সংস্কৃতি অটুট রেখে রানাঘাটের রাস্তায় নামে ময়ূরপঙ্খী। যদিও একসময় যে সারি সারি গোরুর গাড়ি নামত, তা আজ দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’টিতে। বোঝাই যায়, আধুনিকতার দাপটে উদ্যোগী মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজস্ব সংস্কৃতিকে আজও কত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। রানাঘাটের ঐতিহাসিক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ১৮০২ সাল নাগাদ প্রথম এই উৎসবের সূচনা। তখন রানাঘাটের জমিদার পালচৌধুরীরা। যদিও এই উৎসবের সূচনা ঘোষেদের হাত ধরে। নীলচাষের সময় আদিবাসীরা রানাঘাটে আসেন। তাঁদের একটি উৎসবেরই অন্যতম ‘সাফ্রাই’। সকালে গোরুকে স্নান করিয়ে তিলক কেটে দেওয়া হতো। সন্ধ্যায় তাদের দৌড় করানোর প্রতিযোগিতা চলত। সঙ্গে বাজত ধামসা মাদল। পরবর্তীতে হিন্দু এবং সাঁওতাল সংস্কৃতি এক জায়গায় মিশে এর নাম হয় ‘গোষ্ঠবিহার’।

    মঙ্গলবার নববর্ষের সন্ধ্যায় এই গোষ্ঠবিহার শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। তবে সে যুগের গ্যাসবাতির পরিবর্তে আজ নজর টানে চন্দননগরের আকর্ষণীয় আলোকসজ্জা। ধামসা মাদল ম্লান হয়েছে ধীরে ধীরে। তবু প্রবীণরা আশ্বস্ত হন এই ভেবে, ‘সংস্কৃতিটা বেঁচে আছে, এটাই অনেক।’ রানাঘাট পুরসভার চেয়ারম্যান কোশলদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শোভাযাত্রার পুরনো ছবিটা হয়তো এখন আর দেখা যায় না। তবুও রানাঘাটের এই নিজস্ব সংস্কৃতি অটুট রাখতে যতটুকু উদ্‌যাপন হয়, সেটাই অনেক। বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে বার্তা দেওয়া হয়। বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব, আমাদের রানাঘাটের এই ঐতিহ্যকে আগামীতে বয়ে নিয়ে যাওয়া।
  • Link to this news (বর্তমান)