• মুর্শিদাবাদে ৩ মাস ধরে অশান্তির ছক কষেছে বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠী
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৬ এপ্রিল ২০২৫
  • মুর্শিদাবাদের অশান্তি নিয়ে অনেকেই সাম্প্রদায়িক উস্কানির সন্দেহ করলেও এর মধ্যে যে বড়সড় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী চক্র জড়িত, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে। নতুন ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় নেমে হিংসা, রক্তপাত, অগ্নিসংযোগ আর পাথরবৃষ্টি— কোনওটাই স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের কারণে নয়। কার্যত এর পিছনে রয়েছে জঙ্গি মদত, যার যোগসূত্র রয়েছে বাংলাদেশ ও তুরস্কের। এই সংঘর্ষ আকস্মিকও নয়, গত তিন মাস ধরে চলেছে এর প্রস্তুতি। এই সন্ত্রাসবাদী হিংসা কার্যকর করার জন্য একটি অজুহাত খুঁজছিল বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। ওয়াকফ আইন তাদের কাছে শাপে বর হয়ে ওঠে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

    গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে লালগোলা সীমান্তের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বিশেষ সভায় এসেছিল দুই বাংলাদেশি জঙ্গি। তারা দুজনেই আনসারুল্লা বাংলা টিম বা এবিটিএ-র সদস্য। ওই সভায় এসে তারা ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল, এই জেলায় বড়সড় ‘দাওয়াত’ হবে। এই ‘দাওয়াত’ কথাটি আদতে একটি সাঙ্কেতিক ভাষা বা ইঙ্গিত। যার অর্থ হাঙ্গামা। এমনটাই অনুমান করছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করে দিয়েছেন।

    মুর্শিদাবাদের সূতি, ধুলিয়ান ও সামশেরগঞ্জের বিভিন্ন অংশকে ‘উপদ্রুত’ বানানোর ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়েছে সেই সময় থেকেই। এই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত মূল মাথারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তালিকায় নিষিদ্ধ দু’টি সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এপারের এই সুযোগসন্ধানীদের সঙ্গেই বেশ কিছু লোকজনও চোরাপথে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। তাদের কাজ ছিল উস্কানি, ইন্ধন, সন্ত্রাসে সাহায্য এমনকী গেরিলা কায়দায় হামলা চালানো।

    প্রসঙ্গত মুর্শিদাবাদের হিংসাশ্রয়ী ঘটনার পিছনে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের যে হাত রয়েছে, তা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। অমিত শাহের মন্ত্রক বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। আগাম সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী তিন জেলায় অতিরিক্ত আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। মন্ত্রক সূত্রটি জানিয়েছে, প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা প্রত্যক্ষভাবে এই হিংসায় জড়়িত, যাকে পিছন থেকে সমর্থন করেছে স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা। পরে সেই হাঙ্গামা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এর জেরে নতুন করে রাজ্যে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। সূত্রটি আরও জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠিয়েছে।

    সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, সুতি এবং সামসেরগঞ্জের কয়েকটি খারিজি মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছিল ওই বাংলাদেশী সন্ত্রাসবাদীরা। আকস্মিকভাবে গজিয়ে ওঠা এই ‘ভুঁইফোড়’ মাদ্রাসাগুলির ছিল না কোনও সরকারি অনুমোদন। এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হিংসার ছাপ পরতে পরতে লক্ষ্য করা গিয়েছে। এমনকি ঘটনার সময় কীভাবে এই সাম্প্রদায়িক হিংসা পরিচালনা করা হবে, ফোনে তার নির্দেশ এসেছে বাংলাদেশ থেকেই। এব্যাপারে জঙ্গিপুর মহকুমা এলাকায় ৩০টির বেশি ফোন এসেছে সীমান্তের ওপার থেকে। সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে আরও ৭০টির বেশি ঘরোয়া ‘মোবাইল’ কলকে। ওয়াকফ আন্দোলনকে ইস্যু করে কীভাবে এই হিংসাকে আরও ভয়াবহ করে তোলা যাবে, তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই ফোন কল থেকে। হিংসায় মদতদানকারী এমন ৫০ জনের হদিশ পেয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দারা, যারা এই হাঙ্গামার ছক কষেছিল।

    জানা গিয়েছে, রেললাইনের ওপরে শিশু-কিশোরদের দিয়ে পাথর মজুত করে ট্রেন বেলাইন করা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালানো, নির্দিষ্ট কিছু বসত বাড়িতে হামলা চালানো, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা, অগ্নিসংযোগ ঘটানো, সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া— সবই ছিল এই পূর্ব পরিকল্পনার অন্তর্গত।

    সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদে এই অশান্তির জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অর্থ সরবরাহ করেছে এমন দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের (এনজিও) নাম গোয়েন্দাদের সামনে এসেছে। শুধু তাই নয়, পরিকল্পনা মতো হাঙ্গামা ও অস্থিরতা তৈরির জন্য অর্থ এসেছে ‘তুরস্ক’ থেকে। কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদীদের কায়দায় এই হামলা চালানো হয়েছে। সেই কৌশল অনুসরণ করে মুর্শিদাবাদে নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়েছে। এজন্য হামলাকারীদের দেওয়া হয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।

    আরও জানা গিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার জন্য হামলাকারী পিছু পারিশ্রমিকও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। প্রতিটি হামলাকারীদের পাথর ছোঁড়ার জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত ওই পাথর গত দুই মাস ধরে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেগুলি জঙ্গিপুর মহকুমার সংলগ্ন রেলপথ থেকে পূর্ব থেকেই সংগ্রহ করে হামলাকারীরা স্থানীয় খারিজি মাদ্রাসা এবং বাড়ির ছাদে মজুত করে রেখেছিল। হাঙ্গামার ধরন ও নমুনা দেখে তেমনই অনুমান করেছেন গোয়েন্দারা। কারণ ওই পাথরগুলি রেল লাইনের ধারে ছাড়া আশেপাশে অন্য কোথাও থেকে পাওয়া সম্ভব ছিল না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)