• ম্যাডাম, স্যরেরাই তো নেই! প্রকল্পের কী হবে? প্রশ্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের
    এই সময় | ১৬ এপ্রিল ২০২৫
  • প্রশান্ত ঘোষ

    উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ দেবীনগর কৈলাসচন্দ্র রাধারানি বিদ্যাপীঠে ইকোনমিক্সের শিক্ষিকা ছিলেন প্রিয়াঙ্কা গোহ। শুধু পড়ানো নয়, তিনিই ছিলেন ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নোডাল অফিসার। ডেটা এন্ট্রি, পুরোনো কেস রিনিউ, ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ তৈরি করে ছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভিজ়িট করা, সচেতনতা বাড়ানোর মতো কর্মসূচি চালানোর গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁরই উপরে।

    এমনকী, তাঁর জন্য পরপর দু’বার জেলায় ‘কন্যাশ্রী পুরস্কার’ও এসেছিল স্কুলে। সুপ্রিম–রায়ে একলপ্তে চাকরিহারা প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর তালিকায় নাম রয়েছে প্রিয়াঙ্কারও। স্কুলের ‘মোস্ট ওবিডিয়েন্ট ম্যাম’কে না–পেয়ে স্কুলের পড়ুয়ারা যেমন হতাশ, তেমনই চরম উদ্বেগে স্কুল কর্তৃপক্ষও। কারণ, আগামী দিনে প্রিয়াঙ্কাকে বাদ দিয়ে ‘কন্যাশ্রী’র কাজটা চলবে কী ভাবে?

    রায়গঞ্জের এই স্কুলটি কোনও ব্যতিক্রম নয়। প্রায় একই ছবি কলকাতার যাদবপুর বিদ্যাপীঠ, ভাঙড়–১ ব্লকের নারায়ণপুর হাইস্কুল অথবা রাজারহাটের স্যর রমেশ ইনস্টিটিউশনের মতো রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আরও কয়েক হাজার স্কুলে। প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, ‘কন্যাশ্রী’, মিড ডে মিল, ‘ঐক্যশ্রী’ (তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের স্কলারশিপ), বিবেকানন্দ মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ, ওবিসি এবং সংখ্যালঘুদের প্রাক ও পোস্ট মাধ্যমিক স্কলারশিপ, পড়ুয়াদের মধ্যে ট্যাবলেট বিলির (ডি–ওয়ার্মিং এবং আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড) মতো একগুচ্ছ কর্মসূচি চলে স্কুলগুলিতে।

    প্রতিটি স্কুলে এই রকম এক একটি প্রতিটি বিষয়ে একজন করে শিক্ষক–শিক্ষিকাকে নোডাল অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিই ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য সমন্বয় রক্ষার পাশাপাশি স্কুল স্তরে গোটা প্রকল্প দেখভাল করেন। এ ছাড়াও স্কুলের সমবায় ক্লাব, ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট, ক্রেতাসুরক্ষা ক্লাব এবং ইকো ক্লাবের জন্য সরকারি নির্দেশ মেনে স্কুলের একজন শিক্ষক–শিক্ষিকাকে নোডাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ফলে আজ, বুধবার পুরোদমে স্কুল চালু হলে এই প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রেও একটা বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রধান শিক্ষকদের।

    ভাঙড়ের নারায়ণপুর হাই স্কুলের (ওল্ড সাইট) পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় দু’হাজার। এর মধ্যে ১,০৩৮ জন মিড ডে মিল প্রাপক। মিড ডে মিলের হিসেব রাখা, খাবার বণ্টন–সহ সব কিছু দেখাশোনা করতেন ইদ্রিস আলি নামে এক শিক্ষক। আবার তৈসিফ আলি নামে আর একজন শিক্ষক ‘কন্যাশ্রী’, এসটি–এসসি ভাতা সমেত বিভিন্ন সরকারি বৃত্তির বিষয়টি দেখাশোনা করতেন। এই দু’জনেই চাকরি খোয়ানোয় সমস্যায় পড়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ় আহমেদ। তাঁর কথায়, ‘সব কাজ এখন হেড মাস্টারের কাঁধে। এতে স্কুল চালাতে খুব সমস্যা হচ্ছে।’

    একই ভাবে ভাঙড়–২ ব্লকের বামনঘাটা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মানস হালদার জানাচ্ছেন, তাঁদের স্কুলে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা দু’হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিল প্রাপকের সংখ্যা ১,০১২ জন। সুদীপ্ত মাঝি নামে একজন শিক্ষক এই প্রকল্পটি দেখভাল করতেন। আবার ওই স্কুলের শিক্ষিকা সুজাতা ঘোষ ছিলেন স্কুল হেল্থ প্রোগ্রামের নোডাল অফিসার। দু’জনেই সুপ্রিম–রায়ে চাকরি খুইয়েছেন। মানস বলেন, ‘স্কুলের স্বার্থে সুজাতা ও সুদীপ্ত এখন মাঝেমধ্যে তবু স্কুলে আসছেন। ওঁরা যে দিন থেকে স্কুলে আসা ছেড়ে দেবেন, সে দিন সব প্রকল্পের কাজ থমকে যাবে।’

    একই সমস্যা রাজারহাট ব্লকের স্যর রমেশ ইনস্টিটিউশন, অম্বিকা সৌদামিনী বালিকা বিদ্যালয়, রাজারহাট শিক্ষা নিকেতন, যাত্রাগাছি প্রণবানন্দ হাইস্কুলেও। বেদিক ভিলেজ লাগোয়া বাগু সপ্তগ্রাম সর্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৩৮৫। এদের মধ্যে ৬৪৩ জন মিড ডে মিল প্রাপক। প্রধান শিক্ষক সুব্রত দাস বলেন, ‘প্রতীক মজুমদার নামে এক শিক্ষক লাইফ সায়েন্সের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে সহযোগিতা করতেন। উনি চলে যাওয়াতে আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।’

    শুধুমাত্র ভাঙড়–২ ব্লকের অবস্থা দেখলেই গোটা রাজ্যের একটা খণ্ডচিত্র পাওয়া যাবে। বিডিও পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই মুহূর্তে ভাঙড়ের ৩৮টি জুনিয়র ও হাইস্কুলে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। এখানে ফি বছর দশ হাজার মেয়ে কন্যাশ্রী ভাতা পায় এবং ১৮ হাজার পড়ুয়া প্রতিদিন মিড ডে মিল খায়। এই পরিস্থিতি সামলাতে প্রধান শিক্ষকরা রীতিমতো অসুবিধায় পড়ছেন।’

    পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণাংশু মিশ্র বলছেন, ‘একসঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর চাকরি গেলে এই সামাজিক প্রকল্পগুলোও মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ, বাকি শিক্ষকরা বাড়তি ক্লাসের চাপ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি এই সব প্রকল্পের কাজ চালাবেন কী ভাবে। ফলে প্রকল্পগুলির নথি ও তথ্য সংরক্ষণে প্রবল অসুবিধায় পড়তে হবে।’

    (তথ্য সহায়তা— নীলাঞ্জন দাস)

  • Link to this news (এই সময়)