এই সময়, মালদা ও মুর্শিদাবাদ: পার হয়ে গিয়েছে তিন তিনটে দিন। নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে আপাতত ওঁরা একটি স্কুল বাড়ির অস্থায়ী বাসিন্দা। তবে তাঁরা ফিরতে চান এ পারে, নিজেদের ভিটেয়। তাঁদের একাংশ বলছেন, যা লুট হয়ে গিয়েছে, তা আর ফিরবে না। তবু যত তাড়াতাড়ি হোক, তাঁরা নিজেদের বাডি়তে ফিরতে চান।
মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ-ধুলিয়ানের এক দল বাসিন্দার দাবি, হামলার শিকার হয়ে রাতারাতি তাঁরা বাড়িঘর ছেড়ে গঙ্গা পার হয়ে মালদার বৈষ্ণবনগর থানার পারলালপুরে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। লুটপাট হলেও অনেকেই আবার নিজেদের ভিটে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন। পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দিচ্ছে গ্রামের রাস্তায়।
মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন করে গোলমালের খবর নেই। কিন্তু যে অশান্তির জেরে ওই পরিবারগুলি ভিটেছাড়া হতে বাধ্য হলো, তাদের উপরে হামলা চালাল কারা— এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মালদায় যাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা তো বটেই যাঁরা এখনও পড়ে রয়েছেন ধুলিয়ানে তাঁরাও বলছেন, হামলা যারা চালিয়েছে, তারা প্রায় সকলেই অচেনা।
হামলার শিকার যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, অনেকের মুখ ঢাকা ছিল বলে তাঁরা চিনতে পারেননি। তবে সকলেই একমত, হামলাকারীদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যথেচ্ছ লুটপাট চালানো। সোমবারেও মালদার পারলালপুরে আশ্রয় নিয়েছিল কিছু পরিবার। মঙ্গলবার নতুন করে আর কোনও পরিবার সেখানে যায়নি। তবে এই বিষয় নিয়ে রাজনীতির পারদ চড়ছে দুই জেলাতেই।
তৃণমূলের অভিযোগ, অনেকেই নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চাইলেও বিজেপি তাঁদের ফিরতে দিচ্ছে না। বিজেপি অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় নেওয়া শতাধিক মানুষকে নিয়ম করে খাবার-ওষুধ এবং শিশুখাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ধুলিয়ান পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বেতবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা কল্পনা মণ্ডল, মাধবী মণ্ডলরা বলেন, ‘গত শনিবার হামলা চালানোর আগে আমাদের বাড়ির বাইরে বোমাবাজি করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দুষ্কৃতীরা। তার পরে বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে সব কিছু লুট করে। সোনার গয়না, নগদ টাকা কিছুই ছাড়েনি। পালানোর আগে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।’
কারা হামলা চালাল?
ওঁরা বলেন, ‘অন্ধকার ছিল। হামলাকারীদের চিনতে পারিনি। দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য ছিল লুট করা। বাধা দিলে হয়তো আমরা খুন হয়ে যেতাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না–হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরে যেতে চাইছি না।’ ধুলিয়ানের একই এলাকার অন্য দুই বাসিন্দা তৃপ্তি প্রামাণিক, সুভাষ মণ্ডলের কথায়, ‘চোখের সামনে ওরা আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে লুকিয়ে নিজের ঘর জ্বলতে দেখেছি। কিন্তু কাউকেই চিনি না। অনেকেরই মুখ ঢাকা ছিল।’
এখন তা হলে কী করবেন তাঁরা?
কতদিনই বা থাকবেন এই স্কুলবাড়িতে? ওঁদের জবাব, ‘নিজের ভিটেয় তো ফিরতেই হবে। শুনেছি কেন্দ্রীয় বাহিনী নেমেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরতে চাই।’
স্কুলবাড়িতে তাঁদের রাখার পিছনে বিজেপির চক্রান্ত আছে বলে অভিযোগ বৈষ্ণবনগর বিধানসভা কেন্দ্রেের তৃণমূল বিধায়ক চন্দনা সরকারের। তিনি বলেন, ‘যাঁরা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ওঁরা বাড়ি ফিরে যেতে চাইছেন। কিন্তু বিজেপির স্থানীয়রা ষড়যন্ত্র করে ওঁদের এই স্কুলে আটকে রেখেছেন।’ বিজেপির দক্ষিণ মালদা সাংগঠনিক সভাপতি অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘তৃণমূলের এমন মন্তব্য লজ্জাজনক। এত বড় একটা হামলায় শাসকদলের নেতা-নেত্রীরাই নির্যাতিতদের পাশে নেই।’
আতঙ্কে যাঁরা বাড়ি ছেড়ে মালদায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, প্রশাসনের উদ্যোগে তার মধ্যে কয়েকটি পরিবার ফিরেও এসেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং বিএসএফ ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে। তবু তাঁদের আতঙ্ক কাটছে না! ধুলিয়ান পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কৃত্তিবাস সরকার জানান, পুর এলাকার লালপুর, ছেদিপাড়া, বেদবুনিয়া, বোনাপাড়া, রায়গঞ্জ, ঘোষপাড়া এবং পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে জাফরাবাদ, রানিপুর, মোহনগঞ্জ গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা।
পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বেদবুনিয়া পাড়ার কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘আমার বাড়িতে যারা লুটপাট চালিয়েছে, তারা সকলেই বহিরাগত। কারণ, ওদের আগে কখনও এই এলাকাতে দেখিনি। ওরা লুট করতেই এসেছিল।’ ওই ওয়ার্ডেরই ঘনশ্যাম মণ্ডল বলেন, ‘স্থানীয় কেউ লুটপাটে জড়িত নয়। আমার বাড়িতে ঢুকে গোরু, ছাগল যারা লুটে নিয়ে গেল সবাই অচেনা। স্থানীয় হলে তবু তো মুখচেনা মনে হতো।’
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মণ্ডলপাড়ার মন্টু মণ্ডলের মুদির দোকানে ঢুকেও লুটপাট চালায় দুষ্কৃতীরা। মন্টু বলেন, ‘ছেনি দিয়ে দোকানের শাটার ভেঙে দুষ্কৃতীরা ভিতরে ঢুকে নিমেষের মধ্যে সব লুট করে পালিয়ে যায়। দুষ্কৃতীরা যে কেউ-ই এলাকার নয়, তা হলফ করে বলতে পারি।’ পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অজয় মণ্ডলও বলছেন, ‘হাসুয়া, রাম-দা, টাঙি নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতীরা সোনার গয়না লুট করে নিয়ে গেল। কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছি। এত বছর এই এলাকায় আছি। ওদের কাউকে কখনও দেখিনি। সম্ভবত ওরা বাইরে থেকে এসেছিল।’