বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা হবে। সেই স্বপ্ন সত্যি করেছিলেন রূপাঞ্জনা রায়। তবে সেই স্বপ্ন সত্যি করতে তাঁর পাশে ছিলেন মা। কিন্তু ৩ এপ্রিলের পর থেকে সেই চাকরিটা আর নেই। বাবার স্বপ্ন সত্যি করলেও সেই সত্য যে এতটা ভয়ঙ্কর হবে, তা ভাবতেও পারেননি পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের আনন্দপুরের রূপাঞ্জনা রায়। এখন তাঁর মাথায় মনে শুধুই দুশ্চিন্তা।
বাবা অনাদিত্য রায় ছিলেন তৎকালীন যুগের কমার্স গ্র্যাজুয়েট। বাবা কংগ্রেস করতেন, তাই সরকারি চাকরি আর জোটেনি। বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে যেন সরকারি চাকরি করে। আর তা যেন হয় শিক্ষিকার চাকরি। কৃষিকাজ করতেন বাবা। ২০০৮ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেতেই বাংলাতে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন রূপাঞ্জনা। কিন্তু তিনি কলেজে ভর্তি হওয়ার দু এক মাস পর হঠাৎই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বাবার।
তবে বাবার স্বপ্নকে লালিত করেছেন রূপাঞ্জনা, সত্যিও করেছেন। প্রতিবেশী, শুভাকাঙ্খীরা বলেন, রূপাঞ্জনার সেই লড়াইয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছিলেন মা কৃষ্ণা রায়ও। দুধ বিক্রি করে, জমিতে ফসল ফলিয়ে মেয়েকে পড়িয়েছেন তিনি। ছেলে দীপাঞ্জন টুকটাক কাজ করলেও, বোনকে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল না। বাবার স্বপ্ন আর মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমকে পাথেয় করে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বিএড- সবেতেই ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন রূপাঞ্জনা।
এরপরই শুরু হয় শিক্ষক হওয়ার লড়াই। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ায় মেদিনীপুর শহরের এক বাংলার শিক্ষক প্রায় নিখরচায় তাঁকে এসএসসি (SSC) পরীক্ষার জন্য সব ধরনের সাহায্য করেন বলে জানান রূপাঞ্জনা। রূপাঞ্জনার কথায়, ‘মূলত ওই স্যরের সাহায্য আর অনুপ্রেরণাতেই ২০১৬ সালের এসএসসিতে এক চান্সেই পাস করি।’ এর পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফার্স্ট কাউন্সেলিং-র মাধ্যমে নারায়ণগড় ব্লকের শশিন্দা সাগরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন রূপাঞ্জনা।
মা কৃষ্ণা রায় সে দিন চোখের জল আটকাতে পারেননি। মেদিনীপুর শহরের বাংলার ওই স্যরকে ফোন করে শুধু হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। মেয়ের সাফল্যে মায়ের এই চোখের জল আসলে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল। আবারও কেঁদেছেন ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিলও। বুকে পাথর রেখে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তোদেরও কি চাকরি চলে গেল?’
সোমবার বিকেলে রূপাঞ্জনা এই সময় অনলাইন-কে জানান, ‘আমি এবং আমাদের স্কুলের মোট ৮ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছি। ওই দিন ৬ জন স্কুলে গিয়েছিলাম। স্টাফ রুম থেকে সবে ক্লাসে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছি, সেই সময়ই খবরটা আসে। হঠাৎ করেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কখনও ভাবিনি সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দেবে। এত কষ্ট, এত লড়াই করে, যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি পেয়েছিলাম। সব যেন এক নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল। স্টাফ রুম জুড়ে সে যেন হাহাকার।’
এই রায়ের পর কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে যান রূপাঞ্জনারা। স্কুলে তিন জন বাংলার শিক্ষক। দু’জনের চাকরি গিয়েছে। এখন পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি ওই স্কুলে একজনই বাংলার শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর তিওয়ারি বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের যত্ন নিয়ে পড়ানো থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা রূপাঞ্জনা ম্যাডাম সব কিছুতেই পারদর্শী ছিলেন। খুব সহজ ভাবে ছেলেমেয়েদের ব্যাকরণটাও বুঝিয়ে দিতেন। ওনার চাকরি যাওয়া আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ক্ষতি।’
নবম-দশম শ্রেণির সম্পূর্ণা, চন্দ্রশেখর, শুভজিৎ, নন্দিতা, রবিশঙ্কর, সপ্তপর্ণারা বলে, ‘আমরা কোনও কিছু বুঝতে না পারলে টিফিনের সময় কিংবা ছুটির সময় ম্যাডাম বুঝিয়ে দিতেন।’ সেই ম্যাডাম আর আসবেন না, বিশ্বাসই হচ্ছে না তাদের। মন খারাপ রূপাঞ্জনাদের সহকর্মীদেরও।
স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সুমন ঘোষ বলেন, ‘স্টাফ রুমটা ছিল আমাদের কাছে একটা পরিবার। বাংলার রূপাঞ্জনা ম্যাডাম ও মণি ম্যাডাম, জীববিদ্যার অর্পিতা ম্যাডাম, নিউট্রেশনের স্মৃতিকণা ম্যাডামদের অনুপস্থিতিতে সেই স্টাফরুম যেন খাঁ খাঁ করছে। সরকার আর আদালতের কাছে আবেদন, দ্রুত যোগ্যদের সসম্মানে স্কুলে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’
২০১৯ সালে চাকরি পাওয়ার পর ২০২১ সালে রূপাঞ্জনার বিয়ে হয় খড়্গপুর গ্রামীণের ডিমৌলি গ্রামে। স্বামী শান্তনু ঘোষ ২০১৬ সালের এসএসসিতেই (এসএলএসটি) ওয়ার্ক এডুকেশনের টিচার হিসেবে চন্দ্রকোনা জিরাট হাইস্কুলে যোগ দেন। ওয়ার্ক এডুকেশন-ফিজিক্যাল এডুকেশনের প্যানেল বাতিল হয়নি, তবে আদালতে এখনও মামলা বিচারাধীন থাকায় সেই দুশ্চিন্তাও তাড়া করে বেড়াচ্ছে সবসময়।
রূপাঞ্জনা ও শান্তনুর ৩ বছরের এক শিশুকন্যা আছে। সেই সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মাথার উপর ২৫ লক্ষ টাকা লোন। রূপাঞ্জনা জানান, মা অনেক কষ্ট করে পড়িয়েছেন। মাকে একটা পাকা বাড়ি উপহার দিতে লোন করেছিলেন। মে মাস থেকে ইএমআই কাটা শুরু হবে। কিন্তু কী ভাবে কী হবে, সেটাই এখন বুঝতে পারছেন না। চাকরিহারাদের আন্দোলনে মেদিনীপুর, কলকাতায় যাচ্ছেন। আদালত বলেছে, নতুন করে আবেদনের কথা। কিন্তু এত দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়াশোনাও করতে পারছেন না। অন্য চাকরিই বা জোটাবেন কী ভাবে, মাথায় আসছে না কিছুই।
রূপাঞ্জনার প্রশ্ন, ‘বাবার স্বপ্ন যদিও পূরণ করলাম, মায়ের সব লড়াই কি এ ভাবে শেষ হয়ে যাবে?’ তাঁর আবেদন, ‘আমরা যারা যোগ্য, আমাদের চাকরিটা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’ আর রূপাঞ্জনার সেই বাংলার শিক্ষক, মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা কাঞ্চন ঘড়া বলেন, ‘কিছু বলার মতো ভাষা নেই। অনেক লড়াই করে মেয়েটা এই চাকরিটা পেয়েছিল। রূপাঞ্জনার মতো সকল যোগ্যরাই তাদের চাকরি ফিরে পাক, এটাই প্রাণপণে চাইছি।’