• নতুন বছরে পঞ্জিকা চাই? হাজির শেখ মোজাক্কির
    এই সময় | ১৬ এপ্রিল ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    এই বছরে কোন রাশির জাতকের জন্য কী অপেক্ষা করে রয়েছে, আয়–ব্যয়ের মাত্রা কেমন হবে, গৃহপ্রবেশ থেকে উপনয়ন অথবা বিয়ের অনুষ্ঠানে শুভ লগ্ন কোনটি, তিথি মেনে দুর্গাপুজোই বা কবে? বাংলা নতুন বছর শুরু হলে এমনই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসে পড়েন সাধারণ মানুষ। কোথায় মিলবে তার ঠিক উত্তর? পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডে যাঁদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, তাঁদের কাছে এ ব্যাপারে এক এবং অদ্বিতীয় ‘মুশকিল আসান’ শেখ মোজাক্কির।

    পরনে সাধারণ জামা–প্যান্ট। মুখে সর্বক্ষণ লেগে রয়েছে এক চিলতে হাসি। বাঙালির তেরোপার্বণ সংক্রান্ত সমস্ত প্রশ্নমালার উত্তর রয়েছে মোজাক্কিরের ঝুলিতে। উত্তরপত্রের নাম? পঞ্জিকা। নতুন বছর আসার আগে থেকেই এই যুবকের কাজ শুরু হয়ে যায়। ঘরে–ঘরে পৌঁছে যায় একটি করে পঞ্জিকা। মসৃণ হয়ে যায় তিথি–নক্ষত্র খুঁজে নিয়ে শুভ লগ্ন বিচার করা। মোজাক্কিরের কথায়, ‘চৈত্র মাস পড়লেই তো ঘরে ঘরে নতুন বছর নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। আমিও পঞ্জিকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।’

    মোজাক্কিরের বাড়ি পুরুলিয়া মফস্‌সল থানার টাঙরিগ্রামে। বছরের অন্য সময়ে ফল অথবা বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিক্রি করে চলে সংসার। কিন্তু নববর্ষের সময়ে মোজাক্কিরের ব্যস্ততা তুঙ্গে। বলছিলেন, ‘গত সাত–আট বছর ধরে পঞ্জিকা বিক্রি করি বাসস্ট্যান্ড অঞ্চলে।’ যোগ করলেন, ‘এমনও হয়েছে, কোনও কারণে বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। পরের দিন কোনও পরিচিত মানুষ এসে ফেলেন, আমি ছিলাম না–বলে তিনিও পঞ্জিকা কেনেননি।’

    বঙ্গসমাজের তেরোপার্বণ থেকে শুরু করে যে কোনও ধরনের অনুষ্ঠানের শুভদিনটি কবে, তা মোজাক্কিরের ঠোঁটস্থ। তাঁর হাত থেকে পঞ্জিকা কেনাও এখানকার বাসিন্দাদের কাছে এক অলিখিত প্রথা হয়ে গিয়েছে। হুড়া খৈরি ব্লকের বাসিন্দা তপন কুম্ভকার যেমন এ দিনই পঞ্জিকা কিনে বলছিলেন, ‘নতুন বছরের প্রথম দিনে পঞ্জিকা কেনা তো আমাদের পরিবারের রীতি। আগে বাবা কিনতেন, এখন আমি দায়িত্ব নিয়েছি। মোজাক্কিরের থেকেই পঞ্জিকা কিনব বলে অন্য কোথাও যাইও না।’ বাসকর্মী কবীর বাগদির মুখেও এক কথা, ‘নতুন বছরে পঞ্জিকা তো কিনতেই হবে আর সেটা চাই মোজাক্কিরের হাত থেকে।’

    জেলার প্রত্নগবেষক সুভাষ রায় বলছিলেন, ‘বহু বছর ধরে ওকে বাসস্ট্যান্ডে পঞ্জিকা বিক্রি করতে দেখছি। প্রথমবার ওর থেকে পঞ্জিকা কেনার একটা গল্পও রয়েছে। বাড়ি ফিরব বলে অপেক্ষা করছি, সেই সময়ে একটা ছেলে এসে আমাকে নানা পুজোপার্বণ ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পালনের দিন নিয়ে এত সুন্দর করে ব্যাপারটা বলল, একটা পঞ্জিকা কিনেই ফেলি। নাম জানতে চাওয়ায় খানিকটা কুণ্ঠা নিয়ে নিজের নাম বলেছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তো কী হয়েছে, ওর বিক্রির ধরন খুব আন্তরিক।’

    তবে পঞ্জিকার চাহিদা কমছে বলে হতাশাও গ্রাস করেছে মোজাক্কিরকে। বলছিলেন, ‘আগে কত পঞ্জিকা বিক্রি হতো! নতুন প্রজন্মের কাছে এর কোনও মূল্য বোধহয় নেই।’ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘যতই মোবাইল আসুক, পঞ্জিকার কী কোন বিকল্প হয়!’ উত্তরটা অজানা। তবে ঝুলিতে রাশি–গ্রহ–তিথির সমস্ত উত্তর আগের মতোই ফেরি করে চলেছেন মোজাক্কির!

  • Link to this news (এই সময়)