জগন্নাথধামের উদ্বোধনকে মেগা ইভেন্টের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন মমতা, সোনার ঝাড়ুর জন্য নিজেই দেবেন ৫ লক্ষ ১ টাকা!
আনন্দবাজার | ১৬ এপ্রিল ২০২৫
অক্ষয় তৃতীয়ায় দিঘার জগন্নাথ ধাম উদ্বোধনের কর্মসূচিকে রাজ্য তো বটেই, জাতীয় এমনকি, আন্তর্জাতিক স্তরেও ‘মেগা ইভেন্ট’-এর রূপ দিতে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার নবান্ন সভাঘরে সেই সংক্রান্ত প্রস্তুতি বৈঠকে প্রশাসক মমতা যে সমস্ত নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে সেই পরিকল্পনা স্পষ্ট। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ৩০ এপ্রিল। ২৯ তারিখে যজ্ঞ। নবান্ন সভাঘরে মমতা পুরো অনুষ্ঠানের যে রূপরেখা জানিয়েছেন, তাতে ২৮ তারিখ থেকেই গোটা এলাকায় সাজো-সাজো রব পড়বে। পাঁচ মন্ত্রী, মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে রাজ্য পুলিশের ডিজি-সহ রাজ্য প্রশাসনের অন্যতম শীর্ষকর্তারা দিঘায় চলে যাবেন তার আগে। নিয়ে যাওয়া হবে শিল্পপতিদের। আহ্বান করা হচ্ছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের সংবাদমাধ্যমকেও।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে গড়া হয়েছে দিঘার জগন্নাথ মন্দির। ফলে পরিকল্পনা এবং অন্যান্য আবহে পুরীর মতোই করা হচ্ছে তাকে। পোশাকি ভাবে বলা হচ্ছে ‘জগন্নাথধাম’। সেখানে পুরীর মন্দির চত্বরের মতোই চত্বর গড়ে তোলা হয়েছে। থাকছে জগন্নাথের মাসির বাড়িও। সমস্তকিছু যাতে যথাযথ হয়, তার জন্য প্রশাসনের পদস্থ আমলাদের সঙ্গে পুরীর মন্দিরের রাজেশ দ্বৈতাপতির একাধিক বার বৈঠকও হয়েছে। তবে বুধবার বৃহত্তম চমকটি দিয়েছেন মমতা স্বয়ং। রথের সময়ে পুরীর মন্দিরের সামনের রাস্তা সোনার ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দেওয়া হয়। দিঘাতেও তেমনই হবে। সেই সোনার ঝাড়ুর জন্য মমতা নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে ৫ লক্ষ ১ টাকা দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি ঠিক করেছি, এই টাকা দেব ঝাড়ুর জন্য।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, বৃহস্পতিবারই মুখ্যসচিবকে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ওই অঙ্কের চেক কেটে দিয়ে দেবেন তিনি।
নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের জয়রামবাটি ও কামারপুকুরের সন্ন্যাসীদের। ছিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, ইস্কন, মাসির বাড়ির সাধুসন্তরাও। মমতা জানান, তিনি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনের পর সেটি ইস্কনের হাতে তুলে দেওয়া হবে। জগন্নাথধামের দেখাশোনা করবে একটি ট্রাস্ট। তবে মমতার মন্তব্য, ‘‘আমি ওই ট্রাস্টের সদস্য নই।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২৯ তারিখে চার-পাঁচ ঘন্টা ধরে যজ্ঞ হবে। ৩০ তারিখে বেলা ১১টা নাগাদ হবে মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তার পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করবেন ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগীরা। সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুম্বইয়ের সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিধায়ক তথা গায়িকা অদিতি মুন্সি।
যোগীর মহাকুম্ভের পাল্টা?
মমতা সরাসরি বলেননি। বরং তাঁকে বলা হলে জানিয়েছেন, তেমন কোনও প্রতিযোগিতার ইচ্ছা তাঁর নেই। তবে প্রস্তুতি বৈঠকে একাধিক বার এসেছে যোগী আদিত্যনাথের মহাকুম্ভের প্রসঙ্গ। বৈঠকের শুরুতেই মমতা বলেন, ‘‘যে ভাবে হাইপ তুলে মহাকুম্ভ মেলা হয়েছে, সেটা আমরা করিনি। কারণ, ওদের ওখানে জায়গাটা বেশি রয়েছে। দিঘার এখানে জায়গাটা কিন্তু ছোট। তবে মন্দিরের জায়গাটা বড়।’’ মহাকুম্ভে যে ‘উন্মাদনা’ তৈরি করা হয়েছিল এবং সে কারণেই পদপিষ্ট ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছিল, তা আগেও বলেছেন মমতা। বুধবারও তিনি একাধিক বার যোগীর কুম্ভের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তার পাশে রেখেছেন গঙ্গাসাগর মেলাকে। তাঁর কথায়, ‘‘গঙ্গাসাগরে অত মানুষ আসেন! আমরা সমন্বয় করে জল পার করে সকলকে নিয়ে যাই। আবার নিয়েও আসি। এখানেও (দিঘা) সমন্বয়ে কোনও খামতি রাখা যাবে না।’’ দিঘায় অতিথি এবং পুণ্যার্থীদের জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে থেকেই পর্যাপ্ত তাঁবুর ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন মমতা। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, ‘‘ওখানেও (মহাকুম্ভে) তাঁবু ছিল। কিন্তু দু’লাখ না আড়াই লাখ করে টাকা নিয়েছিল। আমরা কারও কাছে কোনও টাকা নেব না।’’ গঙ্গাসাগর মেলায় কারা তাঁবু তৈরি করে সে ব্যাপারেও খোঁজ নেন মমতা। মন্ত্রী সুজিত, ফিরহাদকে মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, গঙ্গাসাগর মেলা হয় শীতকালে। এখন বৈশাখ মাস। কালবৈশাখীর সম্ভাবনা থাকে। ঝড়ে যেন উড়ে না-যায়, তেমন ‘পোক্ত’ তাঁবু তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে সব তাঁবুর আশপাশে দমকলের পরিকাঠামো রাখার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
দিঘায় পাঁচ মন্ত্রী, কলকাতায় ফিরহাদ
বুধবারেই মমতা নির্দেশ দিয়েছেন পাঁচ মন্ত্রীকে ২৭ তারিখে দিঘায় পৌঁছে যেতে। তাঁরা হলেন অরূপ বিশ্বাস, পুলক রায়, স্নেহাশিস চক্রবর্তী, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং সুজিত বসু। থাকবেন ওই মন্ত্রীদের প্রত্যেকের দফতরের সচিবেরাও। মমতা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে বলেছেন রামনগরের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী অখিল গিরিকে। দায়িত্ব দিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তম বারিককেও। তাঁদেরও বৈঠকে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মন্ত্রী ছাড়াও রাজ্য প্রশাসনের পদস্থ আমলাদের একাংশও আগেই দিঘায় পৌঁছবেন। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, তেমনই রয়েছেন রাজ্যপুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা পীযূষ পান্ডে যাবেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তাঁর এবং বাকি পাঁচ মন্ত্রীর কলকাতায় অনুপস্থিত থাকাকালীন প্রশাসনের দায়িত্ব মৌখিক ভাবে মমতা দিয়েছেন মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে। বুধবারের বৈঠকের সকলের উপস্থিতিতেই ওই নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
সমন্বয়ে জোর, মসৃণ যান
পুলিশ, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, দমকল, তথ্য ও সংস্কৃতি— সমস্ত দফতরের মধ্যে সমন্বয় রেখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কলকাতা থেকে দিঘার পথে প্রতিটি থানা এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাখতে বলা হয়েছে অ্যাম্বুল্যান্সও। মুখ্যমন্ত্রী আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি ২৮ এপ্রিল দুপুরের মধ্যে দিঘায় পৌঁছে যাবেন। তার পরে আর দিঘা গেট পার হওয়ার জন্য অনুমতি পাবে না কোনও বেসরকারি যানবাহন। বুধবারের বৈঠকে যানচলাচল মসৃণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। কোলাঘাট থেকে দিঘা পর্যন্ত পুরো সড়কপথ সিসিটিভিতে মুড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশিই নির্দেশ দিয়েছেন হাওড়া স্টেশনেও সিসিটিভি-র নজরদারি বাড়াতে। প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, দিঘার অনুষ্ঠানে যাতে কোনও গোলমাল না হয়, তা শুরু থেকেই নিশ্চিত করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কবে কী
৩০ এপ্রিল, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও ২৯ এপ্রিল শুরু হয়ে যাবে মন্দির উদ্বোধনের প্রাথমিক পর্ব। ওই দিন যজ্ঞ করবেন পুরীর মন্দিরের রাজেশ দ্বৈতাপতি এবং তাঁর সহযোগীরা। থাকবেন ইস্কন কলকাতা শাখার প্রধান সেবায়েত রাধারমণ দাসও। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সকাল ১১টায় মন্দিরে জগন্নাথের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হবে। তার পরে চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বেলা ৩টে থেকে ৩টে ১০ মিনিটের মধ্যে হবে দ্বারোদ্ঘাটন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, মন্দির প্রাঙ্গণে থাকবে তিনটি বাতানুকূল হ্যাঙ্গার। তার মধ্যে প্রথমটিতে হবে মূল অনুষ্ঠান। সেখানে ৬,৫০০ অতিথির জায়গা থাকবে। দ্বিতীয়টিতে থাকবে ৪,০০০ অতিথির জায়গা। তৃতীয়টিতে ২,০০০। তা ছাড়াও গোটা এলাকায় লাগানো হবে বড় এলইডি স্ক্রিন। উৎসাহীরা সেখানও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন।
রেলকে অনুরোধ, তবে কাঁথি নয়
পরিবহণের ক্ষেত্রে রেলকেও বিশেষ ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করবে রাজ্য সরকার। মৌখিক ভাবে সেই অনুরোধ বুধবারেই জানিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, দু’বার দেশের রেলমন্ত্রী থাকার সুবাদে তিনি জানেন, এই ধরনের বড় অনুষ্ঠানে রেলের একটা ভূমিকা থাকে। রাজ্য সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবেও রেলের কাছে প্রয়োজনীয় আবেদন করা হবে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে জগন্নাথধামের উদ্বোধনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রকের কাছে বা প্রকারান্তরে রেলমন্ত্রী বিজেপির অশ্বিনী বৈষ্ণোর কাছে আবেদন জানালেও রাজ্য বিজেপির নেতার এলাকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী দূরত্বই বজায় রাখতে চেয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দিঘা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের কাঁথিতে কিছু তাঁবুর ব্যবস্থা করা হোক। তার পর স্বগতোক্তি করেন, ‘‘কাঁথি অনেকটা দূর হয়ে যাবে। আবার অনেকে তো শান্তি রাখতে চায় না। চায় না শান্তিতে মন্দির উদ্বোধন হোক!’’ উল্লেখ্য, কাঁথিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি। শেষএ ঠিক হয়, দিঘা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বের রামনগরে তাঁবু পড়বে।
খাজা, গজা আর ধ্বজা
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পুরীর মন্দিরের খাজা বিখ্যাত। অনেকেই তা কিনে নিয়ে আসেন। তা অনেকদিন রেখএও দেওয়া যায়। কিন্তু দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে খাজা নয়, পাওয়া যাবে শুকনো গজা! যাতে পুণ্যার্থীরা তা কিনতে পারেন। নিয়েও যেতে পারেন। পাশাপাশিই, মুখ্যমন্ত্রী চান, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতোই মতোই দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের চূড়াতেও বাঁধা হবে একটি ধ্বজা (বা ধ্বজ)। সেটি বিধিসম্মত ভাবে বাঁধার জন্য পুরী থেকে একটি দল আনতে রাজেশ দ্বৈতাপতিকে অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
দিদির বাড়ি?
বৈঠকের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পরে (দ্বৈতাপতির আবেদনে বৈঠকে হাজির সকলে দু’হাত তুলে ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি দেন। বস্তুত, দ্বৈতাপতি তাঁর কথার শুরুতেই বলেছিলেন, ‘‘জয় জগন্নাথ।’’ মমতা অবশ্য ‘জয় জগন্নাথ’-এর সঙ্গেই বলেন, ‘‘জয় বাংলা, জয় হে’’) দৃশ্যতই তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর এক পরিচিত খানিকটা লঘুসুরে বলেন, জগন্নাথের এতদিন নিজের বাড়ি আর মাসির বাড়ি ছিল।