• উচ্চ মাধ্যমিক: সুপ্রিমেই ঝুলে স্কুলের ভবিষ্যৎ
    এই সময় | ১৭ এপ্রিল ২০২৫
  • সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর (এঁদের মধ্যে ১৭ হাজার ২০৬ জনই টিচার) নিয়োগ বাতিল মামলার প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতে মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশন করেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। আজ, বৃহস্পতিবার এই আবেদনের শুনানির কথা। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা উচ্চ মাধ্যমিকের পঠনপাঠন ঘিরে।

    উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের খবর, সুপ্রিম কোর্ট যদি পর্ষদের আবেদনে মান্যতা দিয়ে এই শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়া পর্যন্ত বা নতুন নিয়োগ পর্যন্ত কর্মচ্যুত ‘যোগ্য’ টিচারদের কাজ চালানোর অনুমতি না দেয়, তা হলে রাজ্যের অর্ধেক হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল‍ই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

    চাকরিহারাদের বহাল না রাখলে, বিজ্ঞান তো বটেই, কলা শাখারও অনেক বিষয়ে পঠনপাঠন বন্ধ করতে বাধ্য হবে অনেক স্কুল। এ প্রসঙ্গে অনেকে বীরভূমের মুরারই ব্লকের সর্বোদয় আশ্রম হাইস্কুলের উদাহরণ টানছেন। শিক্ষকের অভাবে গত বছরই নোটিস জারি করে ইলেভেনে ভর্তি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল এই স্কুল।

    তা ছাড়া, এই পরিস্থিতিতে অনেকে বাড়তি ভাতার দাবি জানাচ্ছেন বলেও সংসদে অভিযোগ জমা পড়েছে। যেমন, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও পোষিত মাধ্যমিক স্কুলের নর্মাল সেকশনের (মাধ্যমিক স্তর) বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক–শিক্ষিকারা আর ইলেভেন–টুয়েলভের ক্লাসে যেতে চাইছেন না। এই শিক্ষক–শিক্ষিকাদের মধ্যে যাঁদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট (পিজি) ডিগ্রি আছে, তাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বাড়তি ক্লাসের জন্য পৃথক ভাতার দাবি জানাচ্ছেন। কারণ, তাঁরা পিজি স্কেলে বেতন পান না। একাদশ–দ্বাদশের জন্য নিযুক্ত পার্টটাইম টিচাররাও আর আড়াই–তিন হাজার টাকা ভাতায় ক্লাসে যেতে চাইছেন না। তাঁরাও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক–শিক্ষিকাদের মতো মাসে ১৪ হাজার ৭৭৫ টাকা বেতন চাইছেন।

    অবস্থা যে জটিল, সে কথা মানছেন সংসদ সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, ‘গত বছর ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পরে যে অনেক স্কুলে এমন সব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা আমরা জানি। তবে নিয়োগ তো পুরোপুরি স্কুলশিক্ষা দপ্তর ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ব্যাপার।’

    রাজ্যে এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ৬ হাজার ৯৫২টি। অর্ধেক স্কুলেই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক–শিক্ষিকার অভাব। ৮ বছর নিয়োগ হয়নি। ২০২২–এ ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের মাধ্যমে আবার প্রান্তিক ও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলি থেকে দেদার বদলি নিয়ে জেলা এবং মহকুমার স্কুলে চলে গিয়েছেন বহু শিক্ষক–শিক্ষিকা। এর মধ্যে গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিম–রায়ে ১৭ হাজার ২০৬ জন টিচারের চাকরি বাতিল কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। রাজ্যে গ্রাম–শহর মিলিয়ে বহু স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্সের ক্লাস নেওয়ার একজন টিচারও নেই। এ দিকে, টুয়েলভের ক্লাস শুরু হয়েছে গিয়েছে। মাসখানেকের মধ্যে মাধ্যমিকের ফল বেরোলে ইলেভেনে অ্যাডমিশন শুরু হবে। তখন পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হওয়ার আশঙ্কা।

    পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কুড়িছা টিডি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত হালদার বলেন, ‘শিক্ষকের অভাবে আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান শাখা আগেই উঠে গিয়েছে। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক সেকশনটাই উঠে যাওয়ার উপক্রম। চারজন শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে। তার মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের এডুকেশন, দর্শন ও সংস্কৃতের শিক্ষকরাও আছেন। সুপ্রিম কোর্ট এই শিক্ষকদের আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ না দিলে, একাদশের ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে হবে।’ আলিপুরদুয়ারের কালচিনির হ্যামিলটন হাইস্কুলে ১৭ জন শিক্ষক শিক্ষিকা ছিলেন। চাকরি খুইয়েছেন ছ’জন। এঁদের উপরেই নির্ভর করত বিজ্ঞানের পঠনপাঠন।

    এখন অঙ্ক, জীবনবিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞানের এক হাজার পড়ুয়ার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার মুখে। আসন্ন শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান শাখাটাই তুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির বিজাপুর গৌরমহন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাংশুশেখর নায়েকও জানান, চাকরিহারা তিন টিচারের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকের ফিজ়িক্স ও নিউট্রিশনেরই দু’জন। তাঁদের বহাল রাখা না গেলে এই বিষয়গুলির পঠনপাঠন বন্ধ করে দিতে হবে। স্কুলের তহবিল থেকে ভাতা দিয়ে শিক্ষক রাখার ক্ষমতা তাঁদের নেই। একই বক্তব্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির নিশ্চিন্দপুর রাখালদাস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিয় মণ্ডলের। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। অর্থনীতির শিক্ষক উৎসশ্রী–তে বদলি নিয়ে চলে গিয়েছেন। এ বার ফিজ়িক্স, বায়োলজি, ইংরেজি ও হিউম্যান ডেভেল‍পমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একজন পার্টটাইম শিক্ষক রাখা হয়েছে। আর কোনও শিক্ষক রাখার সামর্থ্য স্কুলের নেই।’

  • Link to this news (এই সময়)