• রিভিউ বা বছর শেষের আগেই নিয়োগ, সম্ভব? সংশয় রাজ্যের অবস্থানে
    এই সময় | ১৮ এপ্রিল ২০২৫
  • এই সময়: এক দিকে রাজ্য সরকার বলছে, চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি ফেরতের জন্যে সুপ্রিম কোর্টে তারা রিভিউ পিটিশন করবে। অন্য দিকে, বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দায়ের করা মিসলেনিয়াস অ্যাপ্লিকেশনের শুনানিতে রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিবাল জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এসএসসি–র মাধ্যমে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে।

    চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষিকাদের অনেকেই রাজ্যের এই অবস্থানে বিভ্রান্ত। আইনজ্ঞরাও স্পষ্ট বলতে পারছেন না যে এর পর কী ভাবে এবং কোন যুক্তিতে রাজ্য রিভিউ পিটিশন করবে। করলেও তা কি বৃহস্পতিবারের অবস্থানের বিরোধী হবে না? পাশাপাশি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কী ভাবে হাজার হাজার পদে নিয়োগ শেষ করা যাবে, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকেই।

    এ দিন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার জন্যে ৩১ ডিসেম্বরের সময়সীমা বেঁধে দেন। তার আগে রাজ্য সরকারের অবস্থান জানতে চান। রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিবাল জানান, আদালতের দেওয়া সময়সীমার সঙ্গে সহমত। প্রশ্ন উঠেছে, এর পর কি আর রিভিউ পিটিশনের সুযোগ থাকে?

    সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ এবং আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এ দিন সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বক্তব্য, ‘নিয়োগ–প্রক্রিয়া নিয়ে রাজ্য সরকার যা বলে এসেছে আদালতে, তাতে তারা নিজেরাই রিভিউ পিটিশনের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু চাকরিহারাদের বিভ্রান্ত করতেই রিভিউ পিটিশনের কথা এখনও বলে যাওয়া হচ্ছে।’

    রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রর কথায়, ‘সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী অবস্থা‍ন নিচ্ছে রাজ্য সরকার। কী ভাবে এর পরেও তারা রিভিউ পিটিশন করবে, আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সম্ভবত চাকরিহারাদের বিভ্রান্ত করতেই রিভিউয়ের কথা বলা হচ্ছে।’

    চাকরিহারাদের আইনি লড়াইয়ের জন্যে আইনজীবীদের যে তালিকা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তাতে ছিলেন তৃণমূল সাংসদ তথা প্রবীণ আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায় ধোঁয়াশা আরও বেড়েছে। তিনি মূল প্রসঙ্গে না ঢুকে কপিল সিবালের উপস্থিতি নিয়েই পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। কল্যাণের কথায়, ‘কপিল সিবাল কার হয়ে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছেন সেটা আমার জানা নেই। তাই ওঁর কথার ভিত্তিতে আমি কোনও প্রতিক্রিয়া দেব না।’

    ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের মঞ্চের প্রতিনিধি মেহবুব মণ্ডল অবশ্য আশাবাদী। তিনি বলছেন, ‘আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি। মিসলেনিয়াস অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে রিভিউ পিটিশনের কোনও বিরোধ নেই, এমনটাই বলা হচ্ছে। রাজ্য সরকার যেন মাথায় রাখে, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অ্যাপ্লিকেশন সর্বোচ্চ আপিল নয়। আমরা আমাদের চাকরি ফেরত চাইছি, তাই রিভিউ পিটিশন রাজ্যকে করতেই হবে।’ তাঁরা নিজেরাও রিভিউ পিটিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মেহবুব।

    রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত আরও একটি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজ্য সরকার শেষ করবে কী ভাবে? যোগ্য–অযোগ্য বাছাই করা না গেলে কারা পরীক্ষায় বসবে আর কারা বসবে না, সেটা রাজ্য সরকার ঠিক করবে কী ভাবে?’

    যদিও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, দ্রুত এসএসসি এই তালিকা প্রকাশের বিষয়ে চাকরিহারাদের সব জানাবে। তার পরেও প্রশ্ন উঠেছে, এই বিপুল সংখ্যক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ৩১ মে’র মধ্যে প্রকাশ করা এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়োগ শেষ করা এসএসসির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না। এ ব্যাপারে এসএসসি এখনই অন্তত কোনও দিশা দেখাতে পারেনি। তাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের তরফে দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে একটি চিঠি এসেছে। সেই অনুযায়ী প্রসেস শুরু হয়েছে।

    শিক্ষামহল অবশ্য এত অল্প সময়ে এত বড় নিয়োগ–প্রক্রিয়া শেষ করা নিয়ে সংশয়ে। অতীতে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) ২০১৬ সালে নিয়োগ–বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন–পর্ব, পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ নেওয়া, প্যানেল প্রকাশ এবং কাউন্সেলিং শেষে নিয়োগপত্র ইস্যু করতে প্রায় দু’বছর পেরিয়েছিল। সে বার চারটি স্তর (নবম–দশমের শিক্ষক, একাদশ–দ্বাদশের শিক্ষক, গ্রুপ–সি, গ্রুপ–ডি কর্মী) মিলিয়ে ২৬ লক্ষ প্রার্থী আবেদন করলেও পরীক্ষায় বসেছিলেন ২২ লক্ষ।

    মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যথাক্রমে ১ লক্ষ ৪১ হাজার ও দেড় লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষায় বসেছিলেন। আর গ্রুপ সি এবং ডি–তে প্রায় ২০ লক্ষ। বাম আমলে ১৯৯৭ সালে এসএসসি তৈরি হওয়ার পর প্রথম পরীক্ষা ও নিয়োগ হয়েছিল ১৯৯৮–এ। তার পর ২০১০ পর্যন্ত নিয়মিত পরীক্ষা নিত এসএসসি। কিন্তু এক–এক বছরের নিয়োগ–প্রক্রিয়া সম্পন্নে তখনও বছর গড়িয়ে যেত। রাজ্যে পরিবর্তনের পর ১৪ বছরে মাত্র দু’বার এসএসসি–র নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে।

    নতুন করে নিয়োগ–প্রক্রিয়া শেষে সাড়ে আট মাসের সময়সীমায় এসএসসি–র কর্মকর্তাদেরও অনেকে সংশয়ে। উপরন্তু, রাজ্যের ওবিসি তালিকা বাতিল হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে। তার বিরুদ্ধে রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও কিছু দিন আগে নিজেরাই শীর্ষ আদালতে জানিয়েছে, নতুন করে ওবিসি সমীক্ষা শুরু করেছে রাজ্য। সে সমীক্ষা শেষে আদালতের অনুমতি নিয়ে নতুন তালিকা প্রকাশ না–হলে যে–কোনও সরকারি নিয়োগই ঝুলে থাকার সম্ভাবনা।

  • Link to this news (এই সময়)