এই সময়: বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠেই বারান্দায় বেরিয়ে এলেন দিলীপ ঘোষ। বাইরে তখন সংবাদমাধ্যমের উপচে পড়া ভিড়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। বুমের ঠোকাঠুকি। নববধূ রিঙ্কুর হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন সদ্য বিবাহিত দিলীপ। অন্য হাতে ঠিক করে নিলেন টোপর। এরপরেই সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাতেই জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলে ছয় হাঁকালেন তিনি। চোয়াল শক্ত করে জানিয়ে দিলেন, বিয়ে করলেও রাজনীতির ময়দান ছাড়ছেন না। কারণ, বাংলায় রাজনৈতিক পালাবাদল ঘটানোই তাঁর লক্ষ্য।
বিধানসভা ভোটের মাত্র এক বছর বাকি। তার আগে দিলীপের আচমকা ছাদনাতলায় বসে পড়ায় হতবাক গোটা গেরুয়া শিবির। বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ–ই দিলীপের বিয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক মহলে। জল্পনা ছড়ায়, তবে কি রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিতে চলেছেন দিলীপ? যেমন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাত ধরে’ পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে উঠেছেন কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়? বঙ্গ–বিজেপির ‘দাবাং’ নেতা দিলীপও কি সেই পথে হাঁটতে চলেছেন? শুক্রবার সন্ধ্যায় বৈদিক মতে বিয়ে সেরে সেই চর্চায় জল ঢালতে আসরে নামলেন দিলীপ নিজেই। বিয়ের সাজে তাঁকে সঙ্গত করলেন কনে রিঙ্কুও। এ দিন সন্ধ্যায় নিউ টাউনে নিজের বাংলোয় অনাড়ম্বর বিয়ে সেরে দিলীপ বলেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবন যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। পার্টি যে দায়িত্ব দেবে, পুরো শক্তি লাগিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করব। আমার স্ত্রী রিঙ্কুও পার্টি কর্মী। উনিও পার্টির কাজ করবেন।’ এরপরই চেনা ভঙ্গিমায় দিলীপ ঘোষণা করেন, ‘বাংলায় পরিবর্তন করবই।’
দিলীপ বিলক্ষণ জানেন, তাঁর মুখের কথাতেই শুধু জল্পনার অবসান ঘটবে না। তাই আজ, শনিবার সকাল থেকে দিলীপ ‘রাজনৈতিক জীবন’–এ ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। সকালে নিয়ম মেনে ইকো পার্কে মর্নিং ওয়াক করতে যাবেন। টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বাইটও দেবেন। তারপর যাবেন খড়্গপুরে। সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে তাঁর। এ প্রসঙ্গেই দিলীপের মন্তব্য, ‘কালকেই খড়্গপুর যাব। আমি রাজনৈতিক কর্মী। সেই কাজেই থাকব। সেই সঙ্গে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করব। আমার এবং আমার স্ত্রীর রাজনৈতিক জীবন যেমন ছিল, তেমনই থাকবে।’
আরও মন দিয়ে রাজনীতি করার জন্যই যে তিনি সাতপাকে বাঁধা পড়েছেন, এ দিন সেই বার্তা দেওয়ারও চেষ্টা করেন মেদিনীপুরের প্রাক্তন সাংসদ। তাঁর কথায়, ‘আমি যাতে রাজনৈতিক গতিবিধি ঠিক রাখতে পারি, রাজনৈতিক দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে পারি, এবং সেই সঙ্গে মায়ের দায়িত্বও পালন করতে পারি, তাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।’ ঘনিষ্ঠ মহলে দিলীপ জানিয়েছেন, এ বার থেকে রিঙ্কু মায়ের দেখাশুনো করবেন, আর তিনি নিশ্চিন্তে রাজনীতি করবেন। দিলীপের রাজনৈতিক জীবনে তিনি যে পাঁচিল তুলে দাঁড়াবেন না, সেটা এ দিন স্পষ্ট করেছেন রিঙ্কুও। দিলীপের নববধূ বলেন, ‘আমি দিলীপ ঘোষকে চেনা ফর্মেই দেখতে চাই। পার্টিও ওঁকে যে ভাবে দেখতে চায়, সে ভাবেই দেখতে পাবে। কোনও চিন্তা নেই।’
বিজেপিতে দিলীপ ঘোষের এখন কোনও সাংগঠনিক পদ নেই। ২৪–এর লোকসভা ভোটে হেরে তিনি আপাতত প্রাক্তন সাংসদ। কিন্তু শনিবার তাঁর বিয়েকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটল তা থেকে স্পষ্ট, বঙ্গ–রাজনীতিতে দিলীপ এখনও হেভিওয়েট। ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়–স্বজন ছাড়া তিনি নিজের বিয়ের খবর কাউকে জানাননি। তবুও এ দিন দুপুরে দিলীপের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো শুভেচ্ছাবার্তা আর মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন নিউ টাউন থানার পুলিশ। ভালো–মন্দ প্রতিক্রিয়ায় এ দিন বঙ্গ–রাজনীতি সরগরম রাখলেন তৃণমূল নেতা–নেত্রীরা। আর কার্যত বিনা নিমন্ত্রণে উপহার নিয়ে দিলীপের বাড়িতে হাজির হলেন বিজেপির শীর্ষ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতারা। সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডের মতো কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও বিয়ের দিন ‘দিলীপের পাশে’ থাকতে হাজির হয়েছিলেন সুকান্ত মজুমদার, শমীক ভট্টাচার্য, রাহুল সিনহা, লকেট চট্টোপাধ্যায়, জ্যোর্তিময় সিং মাহাতোরা। তাঁরা সবাই দিলীপের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে এসেছিলেন। ‘রির্টান গিফট’–এ তাঁদের সবাইকে একটি করে পাঞ্জাবি–শাড়ি দেন পাত্র দিলীপ।
এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘দিলীপ ঘোষকে উপেক্ষা করা সম্ভব না। উনি তো পার্টির কাউকেই নেমন্তন্ন করেননি। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী কবর। অনাহুত হয়ে বিয়েবাড়ি চলে যাওয়া কি ঠিক হবে! কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল সাংগঠনিক কাজে কলকাতায় এসেছেন। উনি–ই আমাদের দিশা দেখালেন। বললেন, দিলীপদার বিয়ে বলে কথা। নেমন্তন্ন পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলে হবে না। যেতেই হবে।’ বিজেপি সূত্রের খবর, এরপরেই দিলীপের মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে লকেটের নম্বর। ভেসে আসে, ‘দিলীপদা, আমরা কিন্তু সবাই আসছি।’ ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে নাকি ভেসে এসেছে শুধু ‘হুম’। দিলীপের বাড়িতে এ দিন অবশ্য দেখা যায়নি বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে।
যাঁরা দিলীপের বিয়েতে গেলেন এবং যাঁরা গেলেন না, তাঁরা সবাই এখন তাকিয়ে আছে নতুন ইনিংসে দিলীপ কী ফর্মে থাকেন, সে দিকে। তিনি কি আবার ব্যাট হাতে ছয়ের পর ছয় হাঁকাবেন, নাকি সংসারের মায়াজালে ফর্ম হারাবেন? সময়–ই উত্তর দেবে।